উঠান বৈঠক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামীণ নারীরা নতুন কিছু করার সাহস ও উৎসাহ পাচ্ছেন। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন
উঠান বৈঠক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামীণ নারীরা নতুন কিছু করার সাহস ও উৎসাহ পাচ্ছেন। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন

মিঠাপুকুরের রোসনির স্বপ্ন সফল উদ্যোক্তা হওয়া

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ি এলাকার নারী উদ্যোক্তা রোসনি আক্তার। বয়স ২৩ বছর। দুই ভাই–বোনের মধ্যে রোসনি ছোট। বড় ভাই চিকিৎসক। রোসনি পড়ছেন কারমাইকেল কলেজে। দর্শন বিভাগে, স্নাতক শেষ বর্ষে। বাবা বেঁচে নেই, মা গৃহিণী। বাবা নূরে আলম এবং মা কোহিনুর বেগমের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে চালু করেছেন ‘এন কে হ্যান্ডিক্র্যাফটস হাউস’ নামে ফেসবুক পেজ। পড়াশোনার পাশাপাশি চার বছর ধরে কাপড়ে নকশার কাজ করে আয় করছেন তিনি।

ছোটবেলা থেকেই রোসনি আক্তার জামাকাপড়ে নকশার কাজ করতেন। শখের কাজটিকেই ২০২০ সাল থেকে আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নেন। ইতিমধ্যে গ্রামে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে। সরাসরি তো বটেই, গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্ডার আসে অনলাইনেও। একটু একটু করে বাড়তে থাকে আয়রোজগার। স্থানীয় বাজার থেকে গজ কাপড় কিনে এনে গ্রাহকের পছন্দের ডিজাইনে বানিয়ে দেন পোশাক।

লেখাপড়া আর পোশাকে নকশা ছাড়াও আর কিছু করেন কি না, জানতে চাইলে রোসনি আক্তার বলেন, ‘ইউটিউব দেখে দুই মাস থেকে খাবারের আইটেম বানানো শিখছি। ইতিমধ্যে বাসায় বসে লাড্ডু ও নিমকি বানানোর কাজ করছি। গ্রামের মানুষেরা আমার বাড়ি থেকেই এসব কিনে নিচ্ছেন। জামাকাপড়ে নকশার পাশাপাশি নতুন একটা আয়ের উপায়ও যুক্ত হলো। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট আমার জন্য আশীর্বাদ।’

এখন রোসনির জামাকাপড়ে নকশা আর লাড্ডু-নিমকির ব্যবসা চলছে সমানতালে। ক্রেতা মূলত তাঁর আত্মীয় ও প্রতিবেশীরাই। খাবারের ব্যবসাটি নিয়ে রোসনির অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। আসছে ডিসেম্বর মাসে ইলেকট্রিক ওভেন কিনবেন। জন্মদিনের কেক বানাবেন। এরই মধ্যে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখে নানা রকম কেক বানানোর প্রক্রিয়া রপ্ত করেছেন তিনি।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে এমন উদ্যোগ নিতে গ্রামীণ নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে দেশজুড়ে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযান। এর আওতায় ৭ অক্টোবর বেলা সাড়ে তিনটায় অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে এসেছিলেন রোসনি আক্তার। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের শঠিবাড়ি এলাকার কানুদাস পাড়ায় তানিয়া সুলতানার উঠানে হয় বৈঠকটি। বৈঠক শুরুর আগেই নারীরা সমবেত হতে থাকেন। তারও আগে প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা পৌঁছে যান গ্রামে। চলে উঠান বৈঠকের প্রস্তুতি। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই একসঙ্গে এত নারীর সমাগম তৈরি করে উৎসবের আমেজ।

রোসনি আক্তার (মাঝে), কুইজের সঠিক উত্তর দিয়ে জিতেছেন স্মার্টফোন। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মিঠাপুকুর উপজেলার বিশিষ্টজন মোতাব্বের হোসেন (ডানে) ও আয়োজনটির সঞ্চালক নুসারাদ মিম (বাঁয়ে)

বন্ধসভার বন্ধু নুসারাদ মিমের সঞ্চালনায় শুরু হয় উঠান বৈঠক। বড় পর্দায় দেখানো হয় ইন্টারনেট বিষয়ে নানা তথ্যমূলক ভিডিও এবং সফল নারী উদ্যোক্তাদের গল্প। ভিডিওগুলোর ওপর চলে কুইজ প্রতিযোগিতা। সবার আগে সঠিক উত্তর দিয়ে কুইজের পুরস্কার হিসেবে স্মার্টফোন জিতে নেন রোসনি আক্তার। প্রতিক্রিয়ায় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রোসনি বলেন, ‘খুবই আনন্দ লাগছে। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কুইজের বিজয়ী হিসেবে পাওয়া স্মার্টফোনটি আমার অনেক উপকারে আসবে। ভবিষ্যতে আমি একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। উঠান বৈঠকে এসে নতুন অনেক কিছুই শিখতে পারলাম। এ জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই।’

যাঁর উঠানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই বৈঠক, কথা হয় সেই তানিয়া সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারাটাও আনন্দের। আমার গ্রামেরই কত নারী একসঙ্গে এলেন, উঠানে বসলেন। কী যে ভালো লাগল। ইন্টারনেট থাকলে একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে কত কিছু যে করা যায়—এ বিষয়ে তাঁদের পাশাপাশি আমিও অনেক কিছু জানতে পারলাম; যা আমাদের সবার জীবনেই কোনো না কোনোভাবে কাজে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’

উল্লেখ্য, ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার প্রচারাভিযানটির আওতায় উঠান বৈঠক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামীণ নারীরা নতুন কিছু করার সাহস ও উৎসাহ পাচ্ছেন। পাশাপাশি ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান এখন নিজেরাই করতে পারেন। সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুরের ৮ উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নে গত ২৯ সেপ্টেম্বর উঠান বৈঠক শুরু হয়। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) পর্যন্ত ১ হাজার ৪৪৭টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।