বিতর্কিত কোম্পানির টাকায় রাশিয়া সফর ক্রয় আইনের লঙ্ঘন। এই কর্মকর্তারা গম কেনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
রাশিয়ার একটি বিতর্কিত কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে গম কিনে আসছে সরকার। আর গত দুই বছরে কৃষিপণ্য বিক্রয়কারী এই কোম্পানির টাকায় রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ১৭ কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ রাশিয়ার গম কেনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কোম্পানি প্রডিংটর্গের কাছ থেকে বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ১৯ লাখ টন গম কিনেছে। এই কোম্পানির অর্থায়নে যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা রাশিয়া ভ্রমণ করেন।
জনগণের টাকায় খাদ্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এভাবে বিদেশ সফরের মাধ্যমে সুবিধা নেওয়া অনৈতিক কাজ ও দুর্নীতি।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
রাশিয়া ভ্রমণের সরকারি আদেশে (জিও) এই সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে খাদ্যনিরাপত্তা–বিষয়ক সেমিনার ও কর্মশালার কথা বলা হয়েছে। সফরের সব খরচ প্রডিংটর্গ থেকে দেওয়া হয়েছে বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দুই ভাই মিঞা সাত্তার ও আমিরুজ্জামান সোহেলের মালিকানাধীন কোম্পানি ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক গ্রুপ রাশিয়ার প্রডিংটর্গের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি বা এজেন্ট। ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক গ্রুপ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে কাজ করে বলে ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়।
যোগাযোগ করা হলে মিঞা সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তির আওতায় রাশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে সরকারি কর্মকর্তারা রাশিয়া সফর করেছেন। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
প্রডিংটর্গের কাছ থেকে ২০২২ সালে সরকার ৫ লাখ টন গম কেনে। এতে টনপ্রতি দর প্রায় ৫০ মার্কিন ডলার বেশি পড়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। তখন এভাবে বেশি দরে গম কেনার সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছিল টিআইবি। সরকারি পর্যায়ে চুক্তির ভিত্তিতে (জিটুজি) খাদ্য অধিদপ্তর রাশিয়ার গম কেনে প্রতি টন ৪৩০ ডলারে। যদিও বাজারদর ছিল ৩৮০ ডলারের মতো। এর পরের বছর থেকেই মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের রাশিয়া ভ্রমণ শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানিকারক কোম্পানির অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। বিশেষ করে আমদানিকারক দেশে ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশেষ করে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে গম আমদানি করা হয় এবং সেই সংস্থার অর্থায়নে আমদানি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ করলে পক্ষপাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। এর ফলে দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ১৭ জন কর্মকর্তার রাশিয়া সফর আইনগতভাবে অবৈধ নয়। সরকারের অনুমতি নিয়েই তাঁরা রাশিয়া গিয়েছিলেন। তবে আমি সচিব হিসেবে এ ধরনের কোনো সফরে যাইনি।’
গণখাতে ক্রয় আইন অনুযায়ী, সরকারি পর্যায়ে ক্রয়প্রক্রিয়ায় বেসরকারি তৃতীয় কোনো পক্ষ থাকবে না। এ ছাড়া ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জিটুজি পর্যায়ে পণ্য কেনার বিষয়ে জারি করা একটি পরিপত্রেও বলা হয়েছে, দাম নির্ধারণ ও সমঝোতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর আটজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি থাকবে। এর বাইরে বেসরকারি তৃতীয় কোনো পক্ষ থাকবে না।
যাঁরা রাশিয়া গিয়েছিলেন
সরকারি আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চে সবচেয়ে বেশি কর্মকর্তা রাশিয়া সফরে যান। তাঁরা হলেন খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন, মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মহসীন, উপসচিব উত্তম কুমার রায়, খাদ্য অধিদপ্তরের আইন উপদেষ্টা ও উপসচিব মো. আবু ইউসুফ, উপসচিব মো. কামরুজ্জামান, অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরী।
গত বছরের ২০ থেকে ২৪ মে তিন কর্মকর্তা রাশিয়া সফরে যান। তাঁরা খাদ্যনিরাপত্তা–বিষয়ক সেমিনারে যোগ দিতে যান বলে সরকারি আদেশে উল্লেখ রয়েছে। কর্মকর্তারা হলেন খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক তপন কুমার দাস, খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আবদুস সালাম ও রংপুরের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুল আলম।
‘চ্যালেঞ্জেস অব ফুড সিকিউরিটি’ সেমিনারে যোগ দিতে গত ১৭-২০ ডিসেম্বর রাশিয়া যান আরও তিন কর্মকর্তা। তাঁদের তিনজন সরকারি গম কেনাকাটার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক শাখাওয়াত হোসেন, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এ কে এম মামুনুর রশীদ ও পরিচালক (সংগ্রহ) মো. মনিরুজ্জামান।
মো. মনিরুজ্জামান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রডিংটর্গের আমন্ত্রণে বিদেশ যেতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, তারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেওয়ার পর আমরা গিয়েছি।’
গত বছরের ২১-২৫ মে রাশিয়া যান আরও পাঁচ কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কুলা প্রদীপ চাকমা ও শারমিন ইয়াসমিন, খাদ্য অধিদপ্তরের প্রধান হিসাবরক্ষক রনক সুফিয়া আফসানা, উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মোর্শেদ এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক আবুল কাদের।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এভাবে বিদেশে যাওয়া সরাসরি সরকারের গণখাতে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন। জনগণের টাকায় খাদ্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এভাবে বিদেশ সফরের মাধ্যমে সুবিধা নেওয়া অনৈতিক কাজ ও দুর্নীতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এভাবে কায়েমি স্বার্থ হাসিল যাতে আর কেউ না করতে পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমনটা না করে।