মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির ভিত্তি। গত ২৫ বছরে প্রথম আলো বিচিত্র বিষয়ে ও মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছে। উদ্ধার করেছে দেশি–বিদেশি অজানা তথ্য ও দলিল, সংগ্রহ করেছে ঘটনার নায়ক থেকে সাধারণ মানুষদের অভিজ্ঞতা, প্রকাশ করেছে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়, ছাপিয়েছে কুশীলব ও গবেষকদের লেখা। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে থাকল বাছাই লেখা।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এমনকি পাকিস্তানও একাত্তর–সংশ্লিষ্ট অনেক ঐতিহাসিক গোপন নথি ও দলিল পর্যায়ক্রমে অবমুক্ত করেছে। ফলে ইতিহাসের অনেক জানা-অজানা অধ্যায় পেয়েছে নতুন মাত্রা। এখানে থাকল মার্কিন দলিলে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১–এর ঘটনাপ্রবাহ। প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। সোভিয়েতের পক্ষ থেকে আজ নিক্সনের কাছে চূড়ান্ত বার্তা এল। নিশ্চয়তা দেওয়া হলো, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, সৈন্য প্রত্যাহার ও উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করলে ভারত যুদ্ধবিরতি ও তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। পশ্চিম পাকিস্তানে তার কোনো অভিসন্ধি নেই।
বার্তায় বলা হলো, মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা আমাদের গোপন চ্যানেলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত রাখব। জেনারেল হেগ এজোর্সে অবস্থানরত কিসিঞ্জারের কাছে বার্তা পাঠালেন, ঢাকার কনসাল জেনারেল স্পিভাক আজ এক টেলিগ্রামে জানিয়েছেন, গভর্নর মালিক ও জেনারেল ফরমান আলী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক পরিস্থিতি নিয়ে আর আশাবাদের কিছু নেই। এখন পাইকারি হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। স্পিভাক মত দিলেন, ‘যা করার দ্রুত করতে হবে, নইলে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।’ স্পিভাক আরও জানালেন, ফারল্যান্ড ইসলামাবাদে চূড়ান্ত আপস প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। যদিও তিনি ওয়াশিংটনকে এখনো কিছু জানাননি। হেগ উল্লেখ করেন, সোভিয়েতরা তাদের চূড়ান্ত জবাব দিতে লম্বা সময় নেয় পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভেঙে পড়া প্রত্যক্ষ করতে। যদিও তারা তাদের বার্তায় বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা কথাটি উল্লেখ করেনি কিন্তু তারা যেসব শর্ত বেঁধে দিয়েছে, তার অর্থ প্রকারান্তরে তাই দাঁড়ায়। ইউরি ভরোনৎসোভ আপনার সঙ্গে আলোচনায় ‘ওয়ান-পাকিস্তান’ প্রসঙ্গে যা উল্লেখ করেছিলেন, তার কিন্তু কোনো উল্লেখ তাদের এই আনুষ্ঠানিক জবাবে নেই। আমরা এখন যা মোটামুটি নিশ্চিত ধরে নিতে পারি, তা হলো আমরা এমন ব্যবস্থা নিতে পারি, যা পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখবে। কিন্তু এটা প্রশ্নাতীত যে পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে পাকিস্তান ও চীনের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানের বিষয়টি কিন্তু অনিশ্চিত থাকছে। এদিনই আরেক তারবার্তায় হেগ কিসিঞ্জারের কাছে সপ্তম নৌবহরকে ফিরিয়ে আনতে পরামর্শ চান। গতকাল এজোর্সে কিসিঞ্জার এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানি দূত রাজার কাছ থেকে প্রাপ্ত একটি বার্তার বিষয়বস্তু জানতে পারেন। এতে বলা হয়, সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে (ভারতীয় নৌবাহিনীর আক্রমণ থেকে) পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে। ইয়াহিয়া আজ এক চিঠিতে নিক্সনকে বলেন, সপ্তম নৌবহরকে আমাদের উপকূলে (করাচিতে) শুধু পৌঁছালেই হবে না, ভারতের আক্রমণ থেকে বাঁচতেও এখন একে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। এ থেকেও একটা ধারণা মেলে যে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হয়েছিল।
ইয়াহিয়া ১৪ ডিসেম্বরে এসেও হাল ছাড়েননি। আবেগের সঙ্গে তিনি নিক্সনকে লিখেছেন, এখন তো সবটাই স্পষ্ট। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সামরিক বিজয়ের জন্যই রাশানরা কালক্ষেপণ করেছিল। আর এখন তাদের সমঝোতার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ দখলের পরে পশ্চিম পাকিস্তান জবরদখলে তারা তাদের পেশিশক্তি ব্যবহার করবে। রাশিয়ার ভূমিকা উন্মোচিত এবং ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখন আপনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় উচিত পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তা গ্রহণ করবে। নিয়াজিকে হাল ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়ে এই চিঠিতে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে প্রাধান্য দেন। ফারল্যান্ড কিসিঞ্জারকে এক ব্যাকচ্যানেল বার্তায় জানান, আজ দুপুরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পর ইয়াহিয়া আমাকে টেলিফোন করেন। বলেন, যেকোনোভাবেই হোক অনতিবিলম্বে আমাকে কুড়িটি বি-৫৭ বিমান দিন।
এদিকে ঢাকার কনসাল জেনারেল আজ এক টেলিগ্রামে জানান, জেনারেল নিয়াজি আজ বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে জরুরিভিত্তিতে তার দপ্তরে দেখা করতে বললেন। আমি গিয়ে দেখলাম নিয়াজি ও ফরমান আলী বসে আছেন। নিয়াজি বললেন, আমরা অযথা রক্তপাত বন্ধ করতে চাই। যদিও আমার সৈন্যরা এখনো ভালো অবস্থায় আছে। এ মুহূর্তে তারা বিপদাপন্ন নয়। সামান্য আলোচনার পরে দুজনে সই করে আমাকে একটি চিঠি দিলেন। এতে শর্তসাপেক্ষে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নিয়াজি ও ফরমান আলী ‘আত্মসমর্পণ’ কথাটি এড়ানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। লক্ষণীয়, নিয়াজির এই চিঠিতে যুদ্ধবিরতির শর্তে ’৭১-এর মার্চ থেকে প্রশাসনকে সহযোগিতাকারী অর্থাৎ রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না গ্রহণের কথা বলা হয়।
ইয়াহিয়া ১৪ ডিসেম্বরে এসেও হাল ছাড়েননি। আবেগের সঙ্গে তিনি নিক্সনকে লিখেছেন, এখন তো সবটাই স্পষ্ট। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সামরিক বিজয়ের জন্যই রাশানরা কালক্ষেপণ করেছিল।
নিয়াজি দাবি করেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে। স্পিভাক লিখেছেন, যখন আমি তাকে নির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করলাম, এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বা ইসলামাবাদে অন্য কারও কাছ থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন আছে কি না, তখন তিনি নির্দিষ্টভাবে বলেন, না। ফারল্যান্ড এদিনই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খানের মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে নিয়াজির ওইরূপ ক্ষমতা অনুশীলনে ইয়াহিয়ার সায় রয়েছে। ইয়াহিয়া এই প্রস্তাব দিল্লি ও ভুট্টোর কাছে পৌঁছাতেও অনুমতি দিয়েছেন। ভুট্টো অথবা জাতিসংঘ মহাসচিবকে দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে অবহিত করতে বলা হয়। কিন্তু ভুট্টো তাতে রাজি হননি। ইয়াহিয়া ভারতকে প্রস্তাবটি জানাতে চাইছেন—যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি পুনর্নিশ্চিত হয়ে জাতিসংঘে তাদের মিশনকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয়, ভারতকে এটা বলতে হবে যে, এই বার্তার বিষয়বস্ত সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ। তার কোনো ভূমিকা নেই।
গভর্নর মালিক গতকাল ইয়াহিয়ার কাছে এক বার্তায় উল্লেখ করেন, তার কাছে খবর রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক, নির্বিশেষে সব পশ্চিম পাকিস্তানিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী হত্যা করবে। ফারল্যান্ড আজ এক টেলিগ্রামে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে এ তথ্য দিয়ে বলেন, মালিক ও তার মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধে যেকোনো শর্তে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কবুল করে নিতে।
কিসিঞ্জার হেগের ওই টেলিগ্রামের জবাবে জানান, আমাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা। সবচেয়ে ভালো হয় ব্রিটিশ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারলে। মনে রাখতে হবে, প্রস্তাব এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে ‘বাংলা দেশ’ কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখ ছাড়াই একটা কৃত্রিম রাজনৈতিক ফর্মুলার কথা বলা থাকে। স্পিভাকও যেন ‘বাংলা দেশ’ থেকে নিজকে দূরে সরিয়ে রাখেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলেকজান্ডার হেগ (জুনিয়র) আজ দুপুর ১২টা ২২ মিনিটে সোভিয়েত মিনিস্টার ভরোনৎসোভকে তলব করেন। হেগ বলেন, আপনাদের বার্তা পরীক্ষা করে আমরা দেখলাম, এটা অনির্দিষ্ট ও অসম্পূর্ণ। এমনকি সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, পশ্চিম পাকিস্তানি ভূখণ্ড দখলে ভারতের পরিকল্পনা নেই—এ কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝা ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর মোতায়েনে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকোর সঙ্গে দেখা করে আজ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সন্ধ্যা ৬টায় কিসিঞ্জার, ভরোনৎসোভ ও হেগ ওয়াশিংটনে বৈঠকে মিলিত হন। কিসিঞ্জার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জানে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে এ ধরনের একটি পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্র কবুল করতে পারে না। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জিইয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন বাংলাদেশের মতো ইস্যুতে তাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে যাবে। এদিকে রজার্স ফারল্যান্ডকে এক টেলিগ্রামে জানান, বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা দখল করে নিলে আপনি কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বিরত থাকবেন।
‘বাঙালির গৌরবগাথা মহান স্বাধীনতা’,
প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০০৫