‘জমির পরচা করতে গেলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার কহে হামাক টেন থাউজেন্ড (১০ হাজার) টাকা দিবা হবে। যারা তাক টাকা দেছে, তার পরচা সময়মতো হয়ে যাছে। আর আমারখান দিনের পর দিন থাকে যাছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে সদর উপজেলা সেটেলমেন্ট কার্যালয় নিয়ে অভিযোগ করতে এসে এভাবেই বলছিলেন সদর উপজেলার ফাড়াবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ভবেশ রায়।
আজ সোমবার ঠাকুরগাঁও জেলা শিল্পকলা মিলনায়তনে দুদকের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হয়রানি, দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ নেওয়াসহ নানা অভিযোগের তোলেন সেবাগ্রহীতারা।
আজ সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলে দুদকের ওই গণশুনানি। সেখানে ৩৪টি সরকারি দপ্তরের বিরুদ্ধে ৬০টি অভিযোগ করেন সেবাগ্রহীতারা । অধিকাংশ অভিযোগ তাৎক্ষণিক সমাধান করা হয়। আর কয়েকটি অভিযোগ অনুসন্ধান করতে দুদককে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গণশুনানিতে মো. সাদ্দাম নামের এক পৌরবাসী পৌরসভার সেবা নিয়ে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনের সনদ নিতে গেলে অতিরিক্ত ফি নেওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে নানা হয়রানি করা হচ্ছে। আমার পরিবারের চারজনের জন্মনিবন্ধন করতে তাঁর কাছ থেকে এক হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।’
শহরের সরকারপাড়া মহল্লার বাসিন্দা এমদাদুল হক অভিযোগ করেন, ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিয়ে। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার কোনো নির্ধারিত ফি প্রদর্শন করা নেই। চালক সেবাগ্রহিতার কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। আর আলমগীর হোসেনের অভিযোগ, হাসপাতালের ল্যাবের যন্ত্রপাতি সচল থাকার পরও ল্যাবের দায়িত্বে থাকা লোকজন বাহিরের রোগনির্ণয় কেন্দ্রে তাদের পাঠিয়ে দেন। সেখানে যে বিল আসে, তার একটা অংশ কমিশন পান তাঁরা।
সদর উপজেলার হরিনারায়নপুর গ্রামের মো. রানা অভিযোগ করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সেচ বিভাগের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, সেচপাম্পের লাইসেন্সের জন্য বিএনডিসির এক অফিসার তাঁর কাছ থেকে ৫২ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু এখনো সেচের লাইসেন্স দেননি।
এ ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম জেলা পাসপোর্ট কার্যালয়, পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়, জেলা নির্বাচন কার্যালয়, বিআরটি, ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, শিক্ষা অফিস, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা, নেসকো।
গণশুনানিতে দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করছে। সেই কারণে দুদক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দুদক আইন ২০০৪–এর আওতায় আমাদের যেসব কার্যক্রম চলছে সেখানে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক কাজ রয়েছে। প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকারমূলক কাজের প্যারামিটার বেশি। আজকের এই গণশুনানি হলো দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক কাজ। প্রত্যন্ত এলাকার একজন সেবাগ্রহিতা তিনি যে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তা সম্পর্কে একটি লাইন লিখে অভিযোগ করতে পারেন না। তাঁদের জন্যই দুদক এই গণশুনানির আয়োজন করেছে। আমরাও তাঁর অভিযোগ শুনে সেখানেই সেটার সমাধান দিতে পারব। আবার গুরুতর অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে দুদকের আইন ও নিয়মানুযায়ী পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করা হবে এবং কমিশনের সিদ্ধান্তক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খোরশেদা ইয়াসমীন আরও বলেন, ‘দুর্নীতি একটি নেতিবাচক বিষয়। দুর্নীতি থাকলে আমরা উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারব না। তাই সবার কাছে অনুরোধ, আমরা সবাই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সেবা দিয়ে যাব।’
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় গণশুনানি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন, ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার উত্তম প্রসাদ পাঠক, ঠাকুরগাঁও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ আলী হুসাইসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিরা।