ছয় দিন ধরে ডেঙ্গুতে ভোগা সাত বছরের আদিবার অবস্থা রাতে খারাপ হলে ভোরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন বাবা হাবিবুর রহমান। কিন্তু হাসপাতালে শয্যা খালি নেই জানিয়ে চিকিৎসক তাদের ফিরিয়ে দিতে চাইলে কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে চিকিৎসকের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন এই বাবা। পরে ওই বাবাকে পুলিশে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মারধরের মামলা করেছেন হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। এখন ঢাকার মুগদা থানা–হাজতে বন্দী হাবিবুর রহমান।
এই ঘটনার পর মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু চোখের সামনে স্বামীকে হাতকড়া লাগিয়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে দেখে অসুস্থ মেয়েকে নিয়েই থানায় ছুটে যান হাবিবুরের স্ত্রী সাথী আক্তার। পরে মেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে বাসায় নিয়ে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ অবস্থায় পরিবারটি দিশাহারা অবস্থায় আছে।
ঘটনাটি ঘটেছে আজ বুধবার ভোরে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের অতিরিক্ত চাপ তৈরি হওয়ার কথা এর আগেও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। তবে অসুস্থ সন্তানকে ভর্তি করতে এসে কোনো মা–বাবার এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হওয়ার ঘটনা এই প্রথম ঘটল। হাসপাতালটির চিকিৎসকের আঙুল ভেঙে দেওয়াসহ মারধরের অভিযোগে থানায় হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে জানালেন মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। সন্ধ্যায় হাসপাতালের চিকিৎসক বনি আমিন বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসি মেরামতের কাজ করেন হাবিবুর। আজ দুপুরে মুগদা থানায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হাবিবুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ের অবস্থা খারাপ। চিকিৎসককে স্লিপ দিলাম। তিনি বলেন সিট খালি নাই, অন্য হাসপাতালে যান।’ এ সময় মেয়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল জানিয়ে এই বাবা বলেন, ‘মেয়ে অসুস্থ বলে আমার মাথারও ঠিক ছিল না। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক সিট খালি নেই বলে হাত দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য বাজেভাবে ইশারা করতে থাকেন। তখন তাঁকে বলি, এমন ব্যবহার করছেন কেন, আমরা কি ডাস্টবিন নাকি? এক কথা–দুই কথায় চিকিৎসক তুই তুকারি করা শুরু করলে আমিও তুই তুকারি করি। চিকিৎসক আমাকে থাপ্পড় মারেন। তারপর জরুরি বিভাগের অন্যরাও এসে জড়ো হন।’
‘আমার স্বামীরে থাপ্পড়ও মারছেন আবার পুলিশেও দিছেন। তা–ও আমি ওই চিকিৎসকের কাছে মাফ চাই। আমার স্বামীরে ফেরত দেন। স্বামী না ফিরলে তো মেয়ের চিকিৎসাও করাইতে পারব না,’সাথী আক্তার, ডেঙ্গু আক্রান্ত আদিবার মা
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি নাকি অনেককে মেরেছি, তাহলে তাঁরা আমাকে মারতেন না?’ চিকিৎসক কেন খারাপ ব্যবহার করছেন জানতে চাইলে চিকিৎসকের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া, হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি হওয়ার কথা স্বীকার করেন হাবিবুর রহমান।
মুগদা থানার কাছে উত্তর মানিকনগরে হাবিবুর রহমানের বাসা। বিকেলে থানা থেকে বের হয়ে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, আদিবা বিছানায় শুয়ে আছে। স্থানীয় একজন চিকিৎসক তার হাতে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়েছেন। গত ছয় দিন ধরে জ্বরে আদিবার মুখভর্তি ঘা হয়ে গেছে। ঠোঁটের কাছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ভালো লাগছে না, পেটে ব্যথা করছে।’ রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ এলেও আদিবাকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা করাচ্ছিলেন হাবিবুর রহমান। রাতে অবস্থা খারাপ হওয়ায় ভোর ছয়টার দিকে তিনি মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালটিতে গিয়েছিলেন।
আদিবার সামনেই হাসপাতালে তার বাবার সঙ্গে চিকিৎসকদের বাগবিতণ্ডার ঘটনাটি ঘটেছে। চিকিৎসক তার বাবাকে থাপ্পড় দিয়েছেন, তা–ও দেখেছে আদিবা। তারপর থেকে বাবাকে থানায় আটক অবস্থায় দেখেছে। বাসায় ফেরার পরও এ নিয়েই আলোচনা চলছে। সব মিলে আদিবার ওপর মানসিক চাপ পড়েছে।
আদিবার মা সাথী আক্তার সারা দিন একবার থানা, একবার বাসা করেছেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেন, ‘চিকিৎসক যখন আমার স্বামীরে থাপ্পড় দিছে, তখন আমি জুতা খুলে ডাক্তাররে মারতে চাইছিলাম। মিথ্যা কথা বলব না। তখন নার্স ও অন্যরা আইস্যা আমারে আটকায়। আমার স্বামী মোবাইলে ঘটনার লাইভ করা শুরু করলে সবাই খেপে যান, লাইভ বন্ধ করতে বলেন।’
সাথী আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীরে থাপ্পড়ও মারছেন আবার পুলিশেও দিছেন। তা–ও আমি ওই চিকিৎসকের কাছে মাফ চাই। আমার স্বামীরে ফেরত দেন। স্বামী না ফিরলে তো মেয়ের চিকিৎসাও করাইতে পারব না।’
সাথী আক্তার জানালেন, যে সিট খালি নেই বলে এত কিছু, সেই হাসপাতালেই পরে মেয়েকে ভর্তি করা হয়। তবে সাথী আক্তার বললেন, স্বামীকে পুলিশ যখন থানায় নিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি মেয়েকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির কাগজ ব্যাগে ঢুকিয়েই প্রথমে থানায়, পরে বাসায় চলে যান। এ জন্য হাসপাতাল থেকে ফোন করে তিনি কেন না বলে কাগজ নিয়ে চলে গেছেন, সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন সাথী আক্তার।
বিকেলে যখন সাথী আক্তারের সঙ্গে বাসায় কথা হয়, তখন দেখা যায় আদিবার পাশেই সাথী আক্তারের দুই বছর বয়সী ছেলে নূর ঘুমাচ্ছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় মেয়ে হুমায়রা তখনো স্কুলে রয়েছে, স্কুল শেষে ভ্যানে করে বাড়ি ফিরবে।
সাথী আক্তার বলেন, ‘বাসায় এই ছোট ছেলেকে দেখার কেউ নেই। এখন স্বামীও থানায়। কেমনে আমি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যাব?’
ছেলের খবর শুনে কুমিল্লা থেকে মানিকনগরের বাসায় এসেছেন হাবিবুরের মা হোসনে আরা। তাঁর স্বামী আলাদা থাকেন। হোসনে আরার এক মেয়ে, এক ছেলে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। ছেলে তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেছিল। হাজতবাস করার জন্যও তো যায় নাই। আমার নাতনি মৃত্যুশয্যায় আর ছেলে থানায়। আমি দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার বিচার চাই।’
এ সময় বাসায় হাবিবুর রহমান ও সাথী আক্তারের বোনেরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মানুষ নিরুপায় হয়েই কম খরচে চিকিৎসা করানোর জন্য সরকারি হাসপাতালে যায়। আর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা তো পাওয়াই গেল না, উল্টো পুরো পরিবার হয়রানির শিকার হলো। পরিবারটিকে সহায়তা করার জন্য অন্য কোনো পুরুষ লোকও নেই। সব মিলে দিশাহারা হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
দুপুরে মুগদা থানায় যাওয়ার পর প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই একাধিক পুলিশ সদস্য নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আর সন্তান অসুস্থ হলে অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন থাকেন। অন্যদিকে চিকিৎসকদের ওপরও চাপ বেড়েছে। তারপরও মানবিক দিক বিবেচনা করে হাসপাতালের ওই চিকিৎসক মামলা না করলেও পারতেন। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা না নিয়েও উপায় নেই, পুলিশ সদস্যরা নিরুপায় বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।
সরকারি হাসপাতালে রোগী এলেই ভর্তি করা হয়। শয্যা খালি না থাকলেও রোগী ভর্তি করা হয়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ একটি শিশুর চিকিৎসার জন্য কোনো শয্যা হবে না, এটি ওই বাবার পক্ষে জানা বা বোঝা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে অনলাইনে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করছে। আজ দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর মুগদা হাসপাতালের ঘটনা প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ওই শিশুর বাবাকে হাসপাতালে শয্যা খালি নেই তা জানানো হয়েছিল। তবে তিনি তা মানতে অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে ওই বাবা উত্তেজিত হয়ে চিকিৎসকদের মারধর করেন, আহত করেন।
দুপুরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) চিকিৎসক মো. নিয়াতুজ্জামানের কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আছে, যা বক্তব্য দেওয়ার তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেবেন।
৫০০ শয্যার মুগদা হাসপাতালে আজকে ডেঙ্গু রোগীদের যে পরিসংখ্যান তা হচ্ছে, আগের ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৬০২। ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে আজ সকাল ৮টা) ভর্তি করা রোগী ছিল ১৪১ জন। একজন মারা গেছে। ২৪ ঘণ্টায় ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১৭৬। শয্যায় মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬৬।
হাবিবুর রহমানের ঘটনাকে অত্যন্ত অমানবিক ও দুর্ভাগ্যজনক বলেছেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকেরা দিশাহারা অবস্থার মধ্যে আছেন। ঘটনার পেছনে যা–ই থাকুক, চিকিৎসকের প্রথম দায়িত্ব ছিল শিশুটির যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া। মারধরের ঘটনা ঘটে থাকলে শিশুটি সুস্থ হলে চিকিৎসক চাইলে দুদিন পরেও বাবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বাবা থানা-হাজতে থাকলে শিশুটির চিকিৎসা করানো মায়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়।