মুঠোফোনে সেবা পেতে এক বছরে গড়ে খরচ বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সময়ে মোবাইল ডেটার ব্যবহারও বেড়েছে। মোবাইল অপারেটররা বলছে, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের ব্যয় বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের ওপর।
দেশের শীর্ষ তিন অপারেটর—গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই–সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রাহক মুঠোফোনের পেছনে প্রতি মাসে গড়ে ১৪৭ টাকা খরচ করেছেন। এক বছর আগে গ্রাহক গড়ে ১৩৫ টাকা খরচ করতেন। অর্থাৎ এই এক বছরে গ্রাহকের গড় খরচ বেড়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
অন্যদিকে গ্রাহক এ বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতি মাসে গড়ে ৬ দশমিক ৪ গিগাবাইট (জিবি) মোবাইল ডেটা ব্যবহার করেছেন, এক বছর আগেও যা ছিল সাড়ে ৫ জিবি।
ব্যয় বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণের কথা বলছে অপারেটররা। তারা বলছে, মূল্যস্ফীতিসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের ব্যয় বেড়ে গেছে। মুঠোফোনভিত্তিক সেবার দামও ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বছরের শেষ দিকে এসে টেলিকম খাতে কিছুটা ধীরগতি থাকে। তাই চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) এই খাতের অবস্থা খুব একটা ভালো যাবে না।
ডেটার মূল্যসংক্রান্ত নতুন নির্দেশনার ফলে গ্রাহকদের ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ কমতে দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ গ্রাহক তিন দিনের ডেটা প্যাক ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। মেয়াদে পরিবর্তন আসায় অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন।—তাইমুর রহমান, বাংলালিংকের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান।
এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) অক্টোবরে মোবাইল ডেটার নতুন প্যাকেজের নির্দেশিকার কথা বলছে অপারেটররা। এটা নিয়ে অপারেটররা আপত্তি জানিয়েছিল। এরপরও নতুন নীতি কার্যকর করা হয়। এরপর তা পছন্দ না হওয়ায় আবার নতুন করে নির্দেশনা দেয় বিটিআরসি।
বাংলালিংকের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান তাইমুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেটার মূল্যসংক্রান্ত নতুন নির্দেশনার ফলে গ্রাহকদের ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ কমতে দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ গ্রাহক তিন দিনের ডেটা প্যাক ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। মেয়াদে পরিবর্তন আসায় অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক চাপের কারণে গ্রাহকেরা আমাদের সেবা কম ব্যবহার করছেন। আমরা ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি।’
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে অনলাইনমাধ্যমে প্রচার, মানুষের মধ্যে যোগাযোগ—এসব বেড়ে যাওয়ার কথা। সব মিলিয়ে এ সময়টা টেলিকম খাতের জন্য সুসময়। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। আশঙ্কা প্রকাশ করে অপারেটররা বলছে, নির্বাচনের আগে হরতাল–অবরোধ চলছে। বন্ধ রয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ছাড়া যানবাহন কম চলাচল করলে মানুষের সামগ্রিক যোগাযোগে তা প্রভাব ফেলে। এখন সেটাই ঘটছে। পাশাপাশি দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। অর্থনৈতিক চাপে আছে মানুষ। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে টেলিকম খাতে।
স্বাভাবিকভাবে ট্যারিফ বাড়লে আরপু বা গ্রাহকপ্রতি গড় আয় বাড়বে। এক বছরে অপারেটরদের পরিচালন ব্যয় ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে। তাই গ্রাহকের ব্যয় বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।—আবু সাঈদ খান, লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো।
এ বিষয়ে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি কর্মকর্তা সাহেদ আলম বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব ব্যবসার ওপর পড়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে টেলিযোগাযোগ খাত এমন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে আমরা আশাবাদী।’
অপারেটররা বলছে, মূল্যস্ফীতিসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের ব্যয় বেড়ে গেছে। মুঠোফোনভিত্তিক সেবার দামও ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বছরের শেষ দিকে এসে টেলিকম খাতে কিছুটা ধীরগতি থাকে। তাই চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) এ খাতের অবস্থা খুব একটা ভালো যাবে না।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক কেব্লডটকোডটইউকে বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেটের দাম পর্যালোচনা করে থাকে। চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৩৭টি দেশে ১ জিবি ইন্টারনেটের দাম পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ইন্টারনেটের সবচেয়ে কম দামের দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ১২ নম্বরে। দেশে ১ জিবি ইন্টারনেটের গড় দাম শূন্য দশমিক ২৩ ডলার।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে ইন্টারনেটের গড় দাম সবচেয়ে কম, ১ জিবি শূন্য দশমিক ১২ ডলার। ভারত আছে ৭ নম্বরে। দেশটিতে ১ জিবি ইন্টারনেটে গড় দাম শূন্য দশমিক ১৬ ডলার। আর বাংলাদেশের পরেই ১৩ নম্বরে আছে শ্রীলঙ্কা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বরের শেষে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৮৯ লাখের বেশি, অক্টোবরের শেষে যা ছিল ১১ কোটি ৯৪ লাখ। অর্থাৎ ১ মাসের ব্যবধানে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কমেছে ৪ লাখ ৫০ হাজার।
গত নভেম্বরে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় ডাউনলোড গতি ছিল ২৩ এমবিপিএস (মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ডে)। ১ বছর আগে ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ এমবিপিএস। আর আপলোডের গতি ৯ দশমিক ২০ এমবিপিএস থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৫৪ এমবিপিএস হয়েছে।
তবে এক বছরে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সাড়ে ৫৫ লাখের বেশি বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরের শেষে দেশে মুঠোফোনের গ্রাহক ১৯ কোটি।
মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশ গত ১ বছরে ১৪ ধাপ এগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওকলার র্যাঙ্কিং বলছে, গত নভেম্বরে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় ডাউনলোডের গতি ছিল ২৩ এমবিপিএস (মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ডে), যা এক বছর আগে ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ এমবিপিএস। অন্যদিকে আপলোডের গতি ৯ দশমিক ২০ এমবিপিএস থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৫৪ এমবিপিএস হয়েছে।
বাংলাদেশে টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি গ্রাহক সংখ্যার পরিসংখ্যান ছাড়া আর কোনো তথ্য দেয় না। ৯০ দিনে কেউ একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই তাঁকে বিটিআরসি গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করে।
অন্যদিকে টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া প্রতি প্রান্তিকের পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরস রিপোর্ট দিয়ে থাকে। ওই প্রতিবেদনে অপারেটরদের মার্কেট শেয়ার থেকে শুরু করে ব্যবহারকারীদের মাসিক খরচ, ব্যবহারকারীরা কত জিবি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন—এসবের বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা থাকে।
এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে ট্যারিফ বাড়লে আরপু বা গ্রাহকপ্রতি গড় আয় বাড়বে। এক বছরে অপারেটরদের পরিচালন ব্যয় ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে। তাই গ্রাহকের ব্যয় বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক, তবে টেলিকম খাতের নির্ভরযোগ্য তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যায় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তা দেয় না।