আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সমতলে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পার্বত্য অঞ্চলে তা হয়নি; বরং অবনতি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হবে। তার জন্য গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে যেতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের উচিত হবে পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম এবং জনগণের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আজ শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই আলোচনার আয়োজন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কাদের দখলে বা ইজারায় আছে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, এটা এই সরকারের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।
সংবিধানে মূল সমস্যাগুলো কী, তা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সংবিধানে যেসব মৌলিক সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হলো অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে স্বীকৃতি না দেওয়া। সংবিধান সংস্কার কমিশন যেন এটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। সরকারিভাবেই এটার স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিদের বাইরে অন্য জাতিদের সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তাঁরা (অন্যান্য জাতি) নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে মনে করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরোধ জিইয়ে রাখা হয় উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো ব্যবস্থাকে স্বচ্ছতার মধ্যে আনতে হবে, জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। সে কারণে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে যেতে হবে।
অধ্যাপক স্বপন আদনান বলেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে পাহাড়ে সংকট রয়ে গেছে। নিপীড়ন করলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
সরকার পতনের পর পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে উল্লেখ করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, এখন বরং সেখানকার পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য গণতদন্ত কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেন তিনি।
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু পাহাড়ে হত্যাকারীদের পরিচয় প্রকাশ এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করেন।
বাঙালি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সম্পত্তির ধারণা এক নয় উল্লেখ করে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বাঙালিদের সম্পত্তির ধারণা ব্যক্তিগত, আর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর হচ্ছে সামষ্টিক সম্পত্তির অধিকারের ধারণা। সে কারণে ব্রিটিশরা যখন সম্পত্তির জরিপ পরিচালনা করে, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামকে জরিপের বাইরে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশ আমলেও জরিপ হয়নি। পাহাড়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা তখনো ছিল না, এখনো নেই। যদি জরিপই না করা হয়, তাহলে তাদের কাছে কাগজ চাওয়া হয় কোন যুক্তিতে?
গণতান্ত্রিক সংবিধান না হলে পাহাড়ে গণতন্ত্র আসবে না উল্লেখ করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, নতুন সংবিধানে সবার অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।
গোলটেবিল আলোচনা সঞ্চালনা করেন ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা। সঞ্চালনার পাশাপাশি লিখিত বক্তব্যে তিনি জাতীয় সংবিধানে পাহাড়িদের জাতিসত্তা ও ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি, সরকারি চাকরিতে ও সব সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে পাহাড়িদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ দেওয়াসহ সাত দফা দাবি তুলে ধরেন।
মাইকেল চাকমা বলেন, সরকারের পতনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের বুক থেকে এখনো ফ্যাসিস্ট শাসনের জগদ্দল পাথর সরে যায়নি। পাহাড়ের মানুষ এখনো বুক ভরে মুক্ত নিশ্বাস নিতে পারছে না।
গোলটেবিল আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা।