সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে বাংলাদেশে যা বলা হয়েছে, তা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার। তিনি বলেছেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনো কোনো আলোচনা করেনি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গতকাল সোমবার এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র মিলার এ কথা বলেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করা হয়, সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, দেশটির সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দখল করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আর বিএনপি তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করতে চায়। এ কারণে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হবে; যদিও গত ১৫ বছর তিনি বাংলাদেশের জনগণের মতামতের প্রতিফলন ছাড়াই ক্ষমতায় আছেন। এসব তথ্য সত্য, নাকি ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ পর্যায় থেকে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে? কোনো কারণ ছাড়াই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
জবাবে মিলার বলেন, ‘আমি শুধু বলব যে এটি সঠিক নয়। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করি। আমরা কখনোই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নেওয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা করিনি।’
বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতে বেশ কিছুদিন ধরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি আলোচনায় রয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ১৪ জুন দ্বীপটি নিয়ে বক্তব্য দেন। তিনি জাতীয় সংসদে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যারা বন্ধু, তাদের শত্রুর প্রয়োজন নেই। বেশ কিছু সময় আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার বাগে রাখতে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিয়েছে। এখন নির্বাচনকে উপলক্ষ করে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এটা কেবল দুরভিসন্ধিমূলকই নয়, তাদের ‘রেজিম চেঞ্জ’–এর কৌশলের অংশ। তারা সেন্ট মার্টিন চায়, কোয়াডে (যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোট) বাংলাদেশকে চায়।
পরে ২০ জুন সংসদে সেন্ট মার্টিন নিয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আরেক জোটসঙ্গী জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, আমেরিকা যখন কোনো দেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে, তখন সেই দেশের সরকার বা বিরোধী দলের চেয়ে জনগণের জন্য বেশি দুর্ভোগ বয়ে আনে।
ইনু আরও বলেন, ‘আমাদের এখন ভাবার সময় এসেছে, আমেরিকার হঠাৎ এই অতি উৎসাহের হেতু কী? গণতন্ত্র, নাকি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ?’
২১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সুইজারল্যান্ড ও কাতার সফর নিয়ে গণভবনে যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তাতেও উঠে আসে সেন্ট মার্টিন প্রসঙ্গ। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কাউকে লিজ (ইজারা) দিলে ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটা তাঁর দ্বারা হবে না।
প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল, কীভাবে? তখন তো গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। তাহলে এখন তারা দেশ বিক্রি করবে, নাকি সেন্ট মার্টিন বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে আসতে চায়?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এতটুকু বলতে পারি, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, আমার হাত থেকে এই দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না। ওই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। আর এখনো যদি আমি বলি, ওই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমাদের ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটি হবে না।’
২২ জুন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেন্ট মার্টিন নিয়ে কথা বলেন। গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা তাঁর রাজনৈতিক কৌশল। এখন এসব বক্তব্য দিয়ে তাঁরা সুবিধা নিতে চান।
দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গতকাল মুখপাত্র মিলার আরও বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্বকে গুরুত্ব দিই। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনসহ গণতন্ত্রের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে আমাদের সম্পর্ককে জোরদারের চেষ্টা করি।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে ব্রিফ্রিংয়ে করা প্রশ্ন ও উত্তরগুলো উল্লেখ করা হয়। এতে দেখা যায়, ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন ছিল। বলা হয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত রোববার ছয়জন মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের একটি চিঠির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি কংগ্রেস সদস্যের শত্রু বলে অভিহিত করেছেন। ছয় কংগ্রেস সদস্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির ছয় সদস্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আহ্বান যাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিক্রিয়া কী?
জবাবে মিলার বলেন, ‘আমি সেই চিঠি দেখিনি। এ বিষয়ে মন্তব্য করার আগে আমি বিস্তারিত পর্যালোচনা করতে চাই।’