এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় গিয়ে দেখা হয়েছিল মোসাম্মত আমেনা খাতুন (৩৫) নামের একজন তাঁতির সঙ্গে। অনেক টাকা ঋণ করে স্বামী মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পর ছয় মাস ধরে ‘খেয়ে-না খেয়ে’ সংসার চালাচ্ছিলেন। প্রতিবেদনের প্রয়োজনে তাঁর একটি পারিবারিক ছবি চাইলে ‘ইমো’ আছে কি না জানতে চান। ‘হ্যাঁ’ বলতেই মুঠোফোন নম্বর নিয়ে পরে ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যোগাযোগের জন্য তিনি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছিলেন।
আরেকজন প্রান্তিক নারী মিনু আক্তার (৩২)। স্বামী আরেকটা বিয়ে করার পর তিনি টিকে থাকার লড়াইয়ে নামেন। খুলনায় আট বছরের মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে ২০১৭ সালে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যান। সপ্তাহে একদিন মেয়ে ও মায়ের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পেতেন। চাকরির দুই বছর মেয়াদ শেষ হলে নিয়োগকর্তাকে শর্ত দেন তাঁকে ইন্টারনেটসহ মুঠোফোন ব্যবহারের সুযোগ দিলে তিনি থাকবেন। শর্ত মেনে নেওয়া হলে মিনু একটা স্মার্টফোন কেনেন। ১৫ সেপ্টেম্বর মিনু প্রথম আলোকে বললেন, ইন্টারনেটের প্রয়োজন কতটা, তা ওই সময় উপলব্ধি করেছেন। নিজের ফোনে দিনে তিন–চারবার মেয়ের সঙ্গে কথা হতো। সেই মানসিক প্রশান্তির মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয়। ২০২২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বিদেশে আবার যাওয়ার জন্য এখন বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রে (বিএনএসকে) প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
এ পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে, নারী কি শুধু যোগাযোগের প্রয়োজনেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন? এর উত্তরে খুব বড় করে ‘না’ বলতেই হবে। কারণ, দূরে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি অনেক নারীর স্বপ্নপূরণ, অনেকের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প সৃষ্টি করেছে ইন্টারনেট। বিদেশে পড়তে যাওয়া, ফ্রিল্যান্সিং, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, তথ্যপ্রযুক্তি, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং—কোথায় নেই নারীর বিচরণ! একটি শোরুম বা অফিস কক্ষ নেওয়ার মতো পুঁজি নেই—এমন অনেক নারী শুধু ইন্টারনেটকে উপজীব্য করে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন বাড়িতে বসে। এভাবে নারীর ক্ষমতায়নে, সমতা অর্জনের পথে লড়াইয়ে শক্তি জুগিয়ে চলেছে ইন্টারনেট।
সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত সর্মি রায়কে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের অনেকে মা–বাবাকে বলতেন, ‘এই মেয়ে কোনো কাজে আসবে না, ডাস্টবিনে ফেলে দাও।’ সর্মিই এখন সংসারের খরচ টানেন। ২০২১ সালে ‘অহনা রন্ধনশালা’ নামে খাবারের অর্ডার নেওয়ার উদ্যোগ গড়ে তোলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর সর্মি বলেন, ‘আমার মতো প্রতিবন্ধী উদ্যোক্তার জন্য স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট খুবই জরুরি। ইন্টারনেট এখন আমার রোজগারের অন্যতম উৎস। অনেক অর্ডার আমি অনলাইনে পাই।’
নারীর ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে
মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) প্রতিবেদন বলছে, মুঠোফোনের মালিকানা ও মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাংলাদেশের নারীরা এখনো পিছিয়ে থাকলেও গত ৬ বছরে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ২০১৮ সালে জিএসএমএ প্রকাশিত ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’-এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ নারী ছিলেন মুঠোফোনের মালিক। ১৩ শতাংশ নারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন। পুরুষের সঙ্গে তুলনা করলে এ দুটো ক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে পড়ার হার ছিল যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ ও ৬৩ শতাংশ।
চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৬৮ শতাংশ নারী মুঠোফোনের মালিক। আর মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ২৪ শতাংশ নারী। পুরুষের তুলনায় এ দুটো ক্ষেত্রে নারীর পিছিয়ে থাকার ব্যবধানও কমেছে। এ হার যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়ই অনলাইন কল, ভিডিও কল এবং অনলাইনে বিনোদনের জন্য মুঠোফোনে ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করেন। নারীদের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ অনলাইনে খবর পড়েন, ১২ শতাংশ চাকরি ও ব্যবসা-সংক্রান্ত তথ্য অনলাইনে খুঁজে থাকেন।
তাই নারীর ক্ষমতায়নে ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন এক বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। নারীদের হাতে-কলমে ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশে দুই হাজার ইউনিয়নে গ্রামীণ নারীদের নিয়ে উঠানবৈঠক করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া বিশেষ এ কার্যক্রম চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
নারীর আগ্রহ অনেক
মুঠোফোনের মালিকানা আর ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার মধ্যেও নারীর জন্য একটি ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যায় জিএসএমএর প্রতিবেদনে। সেটি হচ্ছে, পুরুষের তুলনায় দেশের নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী বেশি। দেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর ৫৩ শতাংশ ও পুরুষের ৪৬ শতাংশ আরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চান।
মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে ইন্টারনেটকে অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহারে নারীদের আগ্রহ বেশি বলে মনে করেন রাজধানীর ফ্রিল্যান্সার এমরাজিনা ইসলাম। ২০১১ সালে সম্মান তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় গ্রামীণফোনের কলসেন্টারে কাজ করতেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহী করে। ২০১১ সালে গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে লোগো বানানো শুরু করেন। প্রথম মাসে আয় হয় ২৫ হাজার টাকা। রাত-দিন ইন্টারনেটে তাঁকে কাজ করতে দেখে মা বিশ্বাসই করছিলেন না ‘এই কাজ করে এত টাকা আয় সম্ভব’। একসময় মাও তাঁর কাছে কাজ শিখে কয়েক মাস গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ করে আয় করেছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর এমরাজিনা এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০১৪ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এমরাজিনা টেকনোলজিস প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন ১০ জন নারী গ্রাফিকস ডিজাইনার। বিয়ের পর বিশেষ করে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর পারিবারিক চাপে অনেক নারীদের আর আয় করা হয়ে ওঠে না। তিনি এমন নারীসহ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ত করে এ বছর গড়ে তুলেছেন অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘কাজ৩৬০’। সেখানে খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি, গান, ছবি আঁকা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখানোর জন্য ৯৮৭ জন সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন। সদস্যদের ৯৫ শতাংশই মেয়ে।
এসব ঘটনা আশা জাগায় যে, নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়গুলো শিখে নিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে আসলেই চলে আসে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। ফলে ইন্টারনেটের বড় শক্তি হয়ে ওঠার জন্য নারীর জন্য দরকার ইন্টারনেটকে ভালোভাবে বোঝা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠা। তবে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, উদ্ভাবনের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর চারটি বেসরকারি স্কুলে গিয়ে শতাধিক মেয়ে শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা জানিয়েছিল, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে পাঠ্যবই ও ল্যাব থাকার পরও স্কুলেও শেখার সুযোগ কম। আবার বাড়িতে অভিভাবকেরা ভয় পান যে মেয়ে অনলাইনে থাকলে প্রতারণার ফাঁদে পড়তে পারে। তাই তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তোলার কাজে শামিল হতে অভিভাবকদের উদ্দেশে বলতে হয়, বাড়ির ছেলেসন্তানটিকে যেভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার-উপযোগী ডিভাইস, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ডেটা প্যাক তুলে দেন, সেভাবে মেয়েসন্তানটিকেও দিন। যদি ভয় লাগে, তাহলে আপনার নজরদারি বাড়াতে পারেন। মেয়েকে ইন্টারনেটের সুফল গ্রহণ করতে উজ্জীবিত করতে পারেন।
শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদেরও এখন ইন্টারনেট সম্পর্কে জানতে আগ্রহ বাড়ছে। তাই বিশেষ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটের শিক্ষা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানানো দরকার। কারণ, ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার। এই দুনিয়ায় প্রবেশের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা নিজেরা যেমন ক্ষমতায়িত হতে পারবেন, তেমনি ভবিষ্যৎ নারী প্রজন্মকেও ইন্টারনেটের সুফল ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন।