বাংলাদেশে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ বছর। তবে ২০২২ সালে সৌদি আরবে বাংলাদেশি যে কর্মীদের মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক’ বলে নথিবদ্ধ করা হয়েছে, তাদের গড় বয়স ৪৪ বছর।
সৌদি আরব থেকে উড়োজাহাজে আসা কফিনগুলো একে একে বের করে আনা হলো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। এর একটি কফিনে রয়েছে আবদুল জলিল শেখের মরদেহ (৩৫)। তাঁর মরদেহ নিতে এসেছেন স্ত্রী খাদিজা বেগমসহ স্বজনেরা।
জলিল শেখ গত বছরের শুরুতে সৌদি আরবে যান। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে যান তিনি। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাঠের কফিনে বন্দী জলিলের প্রাণহীন দেহ সম্প্রতি দেশে ফেরে।
কীভাবে জলিলের মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে মৃত্যু সনদে উল্লেখ করা তথ্যের বাইরে আর আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য জানেন না তাঁর স্বজনেরা। একটা ছোট কাগজের টুকরাও অবশ্য কফিনের সঙ্গে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে লেখা, ‘মৃত্যুর কারণ: স্বাভাবিক। ময়নাতদন্ত: করতে চাওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণ: নেই।’
আরও নয়টি কফিনে এসেছে জলিলের মতোই সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের মরদেহ। খাদিজা সৌদি আরবে থাকা জলিলের সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছেন, স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) করে মারা গেছেন তাঁর স্বামী। কিন্তু ময়নাতদন্ত করা না হলে স্বজনেরা জানতে পারবেন না, তরুণ বয়সে হঠাৎ তাঁর মৃত্যুর কারণ কী। সৌদি আরব থেকে কোনো ক্ষতিপূরণও পাবেন না স্বজনেরা।
খাদিজা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ আর স্বামীর পাঁচ লাখ টাকা ঋণের দায়ভার এখন তাঁর কাঁধে। ‘আমার ভবিষ্যৎ কী, আমি জানি না।...কী করব, জানি না।’, বলেন খাদিজা।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদিতে যাওয়া প্রায় ৫০ হাজার কর্মীর একজন জলিল। যাঁদের অনেকেই তরুণ ও স্বাস্থ্যবান। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ বছরে (২০০৮-২২) সৌদি আরবে কমপক্ষে ১৩ হাজার ৬৮৫ বাংলাদেশি কর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালেই মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫০২ জনের। প্রতিদিন গড়ে চারজনের বেশি বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ বছর। তবে ২০২২ সালে সৌদি আরবে বাংলাদেশি যে কর্মীদের মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক’ বলে নথিবদ্ধ করা হয়েছে, তাদের গড় বয়স ৪৪ বছর। সৌদি কর্তৃপক্ষের দেওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মারা যাওয়া বাংলাদেশিদের ৭৬ শতাংশের ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।
গার্ডিয়ান অনুসন্ধান করে দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। সৌদি কর্তৃপক্ষের দেওয়া মৃত্যু সনদে কখনো ‘স্বাভাবিক কারণ’, কখনো ‘হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা’ আবার কখনো ‘শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যার’ কথা উল্লেখ করা হয়। যার ফলে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
১৪ বছরে (২০০৮-২২) সৌদি আরবে কমপক্ষে ১৩ হাজার ৬৮৫ বাংলাদেশি কর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালেই মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫০২ জনের। প্রতিদিন গড়ে চারজনের বেশি বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফেয়ারস্কয়ার বলছে, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে মারা যাওয়া প্রবাসী কর্মীদের ৫০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করা হয় না।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কঠোর পরিশ্রম ও জীবনযাত্রার পরিস্থিতি, শোষণ, চাপ ও হিটস্ট্রোকও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, সৌদি আরবে অভিবাসী কর্মীদের প্রতি ভয়ংকর আচরণ করা হয়। ‘স্পনসরশিপ ব্যবস্থার’ কারণে তারা শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। কখনো কখনো জোর করে অমানবিক পরিবেশে আটকে রাখা হয়, কিংবা জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা কাতার বিশ্বকাপে (২০২২) অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে জড়িত অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনায় ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছিল। বিশ্বকাপ আয়োজনের (২০৩৪) সবুজ সংকেত দেওয়ার আগে ফিফাকে অবশ্যই শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখাতে সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে।
সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সৌদি আরবের উন্নয়নে অভিবাসী কর্মীদের অবদানকে মূল্যায়ন করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। ২৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মীসহ সব অভিবাসী কর্মীর নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে দেশটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অভিবাসী কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করতে মানসম্মত নীতিমালা অনুসরণ করে। যে ক্ষেত্রে মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে তা করা হয়। যথাযথ স্বচ্ছতার সঙ্গে মৃত্যু সনদ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা ও অস্বচ্ছতার কোনো ঘটনা পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও ফিফা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
সৌদি আরব ২০৩৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক হলে সেখানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে বলে মনে করেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, সৌদি আরবে এখনই বাংলাদেশি কর্মীদের মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। এরপর এটা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরই কেবল বাংলাদেশি কর্মীরা সেদেশে যেতে পারেন। তার মানে শারীরিকভাবে যোগ্য হওয়ার পর তাঁরা সৌদি আরবে যেতে পারছেন। তাহলে সেখানে গিয়ে কেন মারা যাচ্ছেন? এরা যদি ইউরোপ বা আমেরিকার নাগরিক হতেন, তাহলে জবাবদিহি করতে হতো। বাংলাদেশ ও সৌদি কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বাংলাদেশি কর্মীদের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করতে হবে।