কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত৵ঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়ে জাতীয় কমিটি হয়েছে।
আইন বলছে, কিডনি রোগীর জীবন রক্ষায় ২২ ধরনের আত্মীয় নিজের একটি কিডনি দিতে পারেন। তিন বছর আগে হাইকোর্টের এক রায়ে কিডনিদাতার পরিধি বাড়াতে আইন পরিবর্তনসহ কিছু উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আদালতের নির্দেশ শোনেনি।
মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুয়ায়ী জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন—মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। এই তালিকার বাইরে অন্য কারও শরীর থেকে কিডনি নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার আইনি সুযোগ নেই।
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর দেওয়া রায়ে আদালত বলেছিলেন, আত্মীয় না হয়েও কেউ আবেগের বশবর্তী হয়ে কাউকে কিডনি দান করতে চাইলে তা যেন তিনি করতে পারেন, তার জন্য আইন সংশোধন করতে হবে।
ঢাকার বাসিন্দা ফাতেমা জোহরার একটি কিডনি ২০১৫ সালে তাঁর মেয়ের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপনের পরেও মেয়ের পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯–এর তিনটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ফাতেমা জোহরা ২০১৭ সালে রিট করেন। সরকার ওই আইন ২০১৮ সালে সংশোধন করে। সংশোধন করে নিকটাত্মীয়ের তালিকা বড় হয়। তবে রিট আবেদনকারীর সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সম্পূরক রুল দেন। ওই রুল নিষ্পত্তি করে আদালত ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর রায় দেন।
আদালতের রায়ে কিডনি কেনাবেচা বন্ধে প্রত্যয়ন বোর্ড গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। আদালত বলেছিলেন, প্রত্যয়ন বোর্ডের কাজ হবে—কিডনি দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে অর্থ লেনদেন হচ্ছে কি না, তা মূল্যায়ন করা; দাতা ও গ্রহীতার মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাখ্যা করা; কোন পরিস্থিতিতে একজন কিডনি দিতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন তা বলা; তাঁদের সম্পর্কের দালিলিক প্রমাণ পরীক্ষা করা; দাতা ও গ্রহীতার পুরোনো ছবি পরীক্ষা করা; কিডনি দানের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারী নেই, এটা নিশ্চিত করা; দাতা ও গ্রহীতার আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন; কিডনি দাতা মাদকাসক্ত নন, এটা নিশ্চিত করা।
ওই রিটের পক্ষে শুনানি করেছিলেন আইনজীবী রাশনা ইমাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওই রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো আবেদন করেনি, আবার তারা রায় বাস্তবায়নও করেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যা করেছে, তা আদালত অবমাননার শামিল। আমরা আবার আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যকে প্রধান করে একটি কমিটি করার নির্দেশনা আদালত দিয়েছিলেন। মন্ত্রণালয় সেই কমিটির ওপর সব দায়িত্ব দিয়েছে।
যাঁরা কিডনি দিতে পারেনমা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন।
বিএসএমএমইউর উপাচার্যকে সভাপতি করে ‘ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটি’ গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা বা ‘ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ অর্থাৎ ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তির কিডনি বা অন্য অঙ্গপ্রত৵ঙ্গ প্রতিস্থাপনে দিকনির্দেশনা, তদারকি ও পরামর্শ দেবে এই কমিটি।
এই কমিটি এ পর্যন্ত তিনটি সভা করেছে। বিএসএমএমইউর উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে খুব শিগগির ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট চালু করা সম্ভব হবে। আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করছি।’
অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, দেশে যেসব হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়, তার প্রতিটিতে একটি করে প্রত্যয়ন কমিটি আছে। ওই কমিটি দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক যাচাই করে। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি প্রত্যয়ন কমিটি থাকা দরকার ছিল, সেটি এখনো করা হয়নি।
বিএসএমএমইউ, সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলোজি হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন, পপুলার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। তবে সব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় না। ঢাকার বাইরে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছিল।
দেশে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কিডনি (১১২১টি) প্রতিস্থাপন হয়েছে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলোজি হাসপাতালে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিডনিদাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার সনদ ও পুলিশের প্রত্যয়নপত্রকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। দেশের বর্তমান আইনটি ঠিক আছে বলে আমার মনে হয়।’