বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীতে দর্শকেরা। বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে
বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীতে দর্শকেরা। বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে

শতবর্ষী বাদ্যযন্ত্রের সুর

অরণ্য–প্রকৃতি থেকেই শুরু হয় পৃথিবীর প্রথম সুর। সেই দ্যোতনা যে মানুষ ঠিক কবে থেকে বাদ্যযন্ত্রে ধরতে চেষ্টা করেছিল, কেউ জানে না। মেসোপটেমিয়ার ‘এআর’ হোক অথবা প্রাচীন ইজিপ্টের ‘হার্প’, সবই তৈরি হয়েছিল অধরাকে স্পর্শের বাসনা নিয়েই। ‘জলতরঙ্গ’ বাদ্যটি পরিচয় পেয়েছে রোমানদের হাত ধরে। আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের বহু দেশের নানা বাদ্যযন্ত্রের কথা উঠে আসে; কিন্তু আমাদের এই ভূখণ্ডের পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা, হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্যও নেহাত কম নয়!

বৈদিক যুগের দুন্দুভি, বেণু, বীণার কথা পাওয়া যাবে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও। পাহাড়পুর-ময়নামতির প্রস্তরফলক ও পোড়ামাটির চিত্রে আছে কাঁসর, করতাল, মৃদঙ্গ বা মৃৎভান্ডর মতো বাদ্যযন্ত্রের চিত্র। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সদর্পে ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’ ধরে রাখার ঘোষণা করেছিলেন। এসব সময়কালকে মেলানোর প্রয়াসই যেন ‘নিরাময়ের ঐকতান’–এর মূল সুর।

রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চলছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী, পরীক্ষামূলক ও ‘আদিবাসী’ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রদর্শনী। বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এ প্রদর্শনীর কিউরেট করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা লুসি তৃপ্তি গোমেজ। তিনি বলেন, একটা কাঠের টুকরার বাদ্যযন্ত্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়া আর সেই যন্ত্র থেকে সুরের দ্যোতনা তৈরি শিল্পী মোহাম্মদ জাকিরকে বিস্মিত করে দিয়েছিল। তখন থেকে শুরু হয় সব ছেড়ে তাঁর যন্ত্র তৈরির কাজ শেখা। এরপর কয়েক বছর ধরে শিল্পী শুধু বাদ্যযন্ত্রই বানিয়ে চলেছেন।

লুসি তৃপ্তি গোমেজ জানান, সেতারের ধুনে শিল্পী জাকিরের আগ্রহ এক তারের সীমানা অতিক্রম করে। দোতারা তৈরির প্রতিটি ধাপ হাতেকলমে করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন সহশিল্পী আজাদুল ইসলাম রাজার সঙ্গে। আজাদুল বিচ্ছেদ গানের পাগল, একতারার বুনন তাঁর হাতে অনবদ্য। একসময় তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান কৃষক দুর্যোধন বর্মন। জোগান দেন একতারা বানাবার কাঁচামাল লাউ, বাঁশ, ছাগলের চামড়া ইত্যাদি।

তবে এই যে সেতার নামে একটিমাত্র বাদ্যযন্ত্রের কথা শোনা গেল, যেন ওর মধ্যেই শত বছর আগে থেকে লুকিয়ে ছিল আজকের এই অনন্য আয়োজনের প্রেরণা।

সে গল্প শোনালেন শিল্পী মোহাম্মদ জাকির নিজেই। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘এই সেতারের বয়স অন্তত ১৩৫ বছর হবে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ছিলেন দ্বিজেন কবিরাজ নামের একজন। সে বহুকাল আগের কথা। তিনি এই যন্ত্রটি বানিয়ে নিজেই অন্তত ৫০ বছর সাধন করেছেন। এরপর সেতারটা দেশভাগের সময় ওপারে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে বাংলায়। সেই দ্বিজেন কবিরাজের বংশধর দুর্যোধন বর্মনের কাছে ছিল বাদ্যযন্ত্রটি। তিনি তুলে দিয়েছেন আমার হাতে।’

ছয় তারের এই সেতারাটিকে ঠিকঠাক করতে করতে কিছুটা বদলে নিয়েছেন জাকির। তবে এই পরির্তনের প্রক্রিয়া ধরেই জাকির ডুবে গেছেন বাদ্যযন্ত্র তৈরির মোহে। ২০২০ সালে এই বাদ্যযন্ত্রটি তাঁর হাতে আসার পর থেকে শুরু হয় আদি বাদ্যযন্ত্র তৈরি, মেরামতের কাজ। দুই বছর ধরে জাকির শুধু বাদ্যযন্ত্রই বানিয়ে চলেছেন। তিনি সব কাজই করেন আমাদের দেশের বিভিন্ন গাছের কাঠ, প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করে। গত বুধবার বিকেলে প্রদর্শনী ঘুরে দেখা গেল অর্জুন, তেঁতুল, বেল, নিম, কদম, ছাতিম অথবা ডুমুরগাছের কাঠ ব্যবহার করে বানানো হয়েছে একতারা, দোতারা, তবলা, খঞ্জনি, বাঁশি, মিরাত, গোপী,  কৃষ্ণকাচি, ঘটক বা বৈরাগীর মতো শতাধিক বাদ্যযন্ত্র।

এই বাদ্যযন্ত্র হাতে এ দেশের বাউলেরা ঘুরেছেন পথেপ্রান্তের। ছড়িয়ে দিয়েছেন অচিন সুর। কখনো যুদ্ধের ঘোষণাও এসেছে বাদ্যযন্ত্রের মধ্য দিয়ে। অথবা কখনো ভাটিয়ালির সুরে ভেসেছে মানুষ, যেখানে যন্ত্রটি ছিল উদাস শিল্পীর প্রাণের আলাপের সারথি। তাই তাকে আর পৃথক করে চেনা হয়নি শ্রোতার। তবে সুর তৈরির সে আধারটির সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে ঘুরে আসতে হবে ‘হারমোনি অব হিলিং’ বা নিরাময়ের ঐকতান প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনীর প্রবেশমুখেই পেয়ে যাবেন ‘চন্দন পাউয়া’ কাঠ দিয়ে বানানো শতবর্ষী সেই সেতারের দেখা। শিল্পী জাকির বলছিলেন, ‘চন্দন পাউয়া হচ্ছে গরিবের চন্দন কাঠ। এখানে রাখা আছে কয়েক শ বছরের পুরোনো এক পুঁথি। মধ্যযুগের কবি জগজ্জীবন গোঁসাইয়ের “বিষহরী পুঁথি” আপনি পাঠ করতে না পারলেও চাইলে শুনতে পারবেন শিল্পী জাকিরের কণ্ঠে। তবে এ জন্য তাঁকে অনুরোধ করতে হবে।’

২৫ নভেম্বর শুরু হয়েছে প্রদর্শনী ‘নিরাময়ের ঐকতান’। ‘অবকল্প’ নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে আজ শুক্রবার ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত। ‘নিরাময়ের ঐকতান’ নিয়ে বুধবার বিকেলে ছিল আলোচনার আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইম রানা আলোচনার এক পর্বে বললেন, বাদ্যযন্ত্র শুধু একটি যন্ত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়।