সামরিক বাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। ‘রাজনৈতিক সংকটকে সামরিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে’ মন্তব্য করে তাঁরা এর বিরোধিতা করছেন বলে জানিয়েছেন।
আজ রোববার রাজধানীর রাওয়া ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা তুলে ধরেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা প্রকাশ করা হয়।
মূল বক্তব্যে ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, দেশের নীতিনির্ধারকেরা যদি বিবেক, বুদ্ধি ও হৃদয়হীন হয়ে না পড়তেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, করুণ, মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটত না। এসব হামলা, আক্রমণ ও পাল্টা প্রতিরোধে অঙ্গহানি ঘটেছে অগণিত মানুষের। অন্ধ হয়েছে বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণ। অসহায় নাগরিকেরা প্রয়োজনীয় ও জরুরি চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। তার ওপরে চলছে ব্লক রেইড করে, সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাড়িঘর, মেস চিনিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনা। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজার হাজার নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী।
ইকবাল করিম ভূঁইয়া মূল বক্তব্য দেওয়ার আগে ছয়জন সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বক্তব্য দেন। আর সমাপনী বক্তব্য দেন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন লে. জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ।
সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের সুরক্ষা দিতে পারি নাই। এখনো সময় আছে। আর কারও যাতে প্রাণ না যায়। তবে আমাদের দায়িত্ব বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকেও রক্ষা করা। টেবিলে বসে ভাগাভাগি করে আমরা এই সেনাবাহিনী পাই নাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই সেনাবাহিনী পেয়েছি। এই সেনাবাহিনী কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে যাতে ব্যবহৃত না হয়। সেই দিকে আমাদের খেয়াল রাখা সবচেয়ে জরুরি।’
মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান (বীর প্রতীক) বলেন, ‘একটি এপিসি থেকে একটি ছেলেকে কীভাবে ফেলে দেওয়া হলো! কী বাহিনী বানিয়েছি আমরা! আমাদের পুলিশ কী রকম অমানুষের মতো আচরণ করেছে, তা আমরা সবাই দেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাচুর্য ছিল না, প্রাণ ছিল। এই সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে, এটা আমাদের কারও কাম্য নয়। সেনাবাহিনী একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান, একে বিতর্কিত করা ঠিক হবে না। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এই আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। হ্যাঁ, অবশ্যই এটা রাজনৈতিক আন্দোলন। দেশের এর আগের সবগুলো ছাত্র আন্দোলনই রাজনৈতিক আন্দোলন।’
মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান (বীর উত্তম) বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি এমন একটি সংবাদ সম্মেলনে আমাকে আসতে হবে। আমি পরিবার থেকে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছি। আন্দোলন হচ্ছে তা আমি দেখেছি, পড়েছি। কিন্তু এটা এমন জায়গায় পৌঁছাবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। যে ঘটনাটা হয়ে গেল, তার পেছনের দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে আমরা দেখি, আমরা প্রথমে তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করলাম। যেসব স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে, তা পুড়িয়ে দিতে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সবাইকে চিন্তা করতে হবে, আর যাতে রক্তপাত না হয়।’
আজিজুর রহমান আরও বলেন, ‘আমি ২৫ বছর হয়েছে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছি। কাউকে গুলি করার আগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ও সহায়তা নেওয়া হতো। তাঁরা দেখিয়ে দিতেন, কে দুষ্কৃতকারী; আর পায়ের নিচে গুলি করতে হবে। কিন্তু এখন তো পাখি শিকার করার মতো করে মানুষ মারা হয়েছে। আমরা এর আগে দেখেছি, সর্বশেষ অবস্থায় সেনাবাহিনীকে নামানো হয়। যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ছিল পরিস্থিতি সামলানো। তারা যদি না পারে, তাহলে এসব বাহিনীর কী দরকার?’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খান বলেন, ‘দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো যেতো। সেনাবাহিনীকে জনগণের প্রতিপক্ষ করা যাবে না। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমরা চাই না আমাদের ভাইয়েরা মনে করুক, সেনাবাহিনী তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।’ তিনি বর্তমান সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘সেনাপ্রধান বলেছেন, “সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে থাকব।” কিন্তু জনগণের পক্ষে থাকতে হলে জনগণের দিকে বন্দুক তাক করে নয়। জনগণের পাশে থাকা মানে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। বিদেশে আমাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধের মধ্যে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিচ্ছে।’
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অতীতে কখনো দেশবাসী বা সাধারণ জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি, তাদের বুকে বন্দুক তাক করেনি।ইকবাল করিম ভূঁইয়া
তিনি আরও বলেন, ‘সেনাপ্রধানের কথা যাতে মাঠে সত্যিকার অর্থে এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেটাই আমরা দেখতে চাই। সেনাবাহিনী জনগণের সত্যিকার অর্থে পাশে থাকবে, সেটাই আমার প্রত্যাশা।’
লিখিত বক্তব্যে ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুটা দেশবাসী দেখেছেন। এর কোনো কিছুই মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। প্রথম পক্ষ অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সারা দেশের শিশু, কিশোর ও তরুণেরা শত উসকানি, হামলা ও নির্যাতনের মধ্যেও ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে ধীরে ধীরে আইন মেনে সামনে পা বাড়াচ্ছিলেন। বিপরীতে দ্বিতীয় পক্ষ যে উপর্যুপরি উসকানি দিল, গুন্ডা-পান্ডা দিয়ে সন্ত্রাস চালাল এবং পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিজিবি নামিয়ে, আকাশে হেলিকপ্টার উড়িয়ে, নির্বিচার গুলি করে অগণিত শিশু, কিশোর ও তরুণের তাজা প্রাণ হরণ করল, তা দেশবাসী কি এত সহজে, এই অল্প সময়ের মধ্যেই ভুলে যাবে?
ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, আক্রমণকারীরা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিরোধের মধ্যে পিছপা হতে বাধ্য হলে, পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবহার করা হলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে। তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কখনো সম্মুখভাগে, কখনো পেছনে ও পাশে দাঁড় করিয়ে অন্য বাহিনীগুলো এই গণ-আন্দোলনের ওপর তাদের জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতির দায় দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর নেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অতীতে কখনো দেশবাসী বা সাধারণ জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি, তাদের বুকে বন্দুক তাক করেনি।
শেষে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক সংকটকে সামরিকীকরণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আমরা সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এর তীব্র বিরোধিতা করছি।’
সমাপনী বক্তব্যে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নুরউদ্দিন খান বলেন, ‘আমি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেছি। জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি। আমাদের বর্তমান সেনাপ্রধান যে কথা বলেছেন, আশা করি তিনি তার সঠিক অবস্থান ধরে রাখবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার।