স্বাস্থ্যসেবা খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ‘সাধারণ চিকিৎসক’ বা ‘জেনারেল প্র্যাকটিশনার’কেন্দ্রিক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। নতুন এ ব্যবস্থা চালু করার এখনই উপযুক্ত সময়। এর জন্য দরকার দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।
আজ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সভাকক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় জনস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা এ কথা বলেন। নাগরিক সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফরমস বাংলাদেশ এ সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
মূল উপস্থাপনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা সাধারণ চিকিৎসককেন্দ্রিক সেবাব্যবস্থা যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, কানাডা, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনে চালু আছে। এ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বা ভৌগোলিক এলাকার মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিযুক্ত রাখা হয়। এখানে বিশেষায়িত কোনো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় না। বিশেষায়িত সেবার জন্য রোগীকে উচ্চতর চিকিৎসাকেন্দ্রে রেফার করা হয়। উচ্চতর চিকিৎসাকেন্দ্রে রেফার করা রোগী দেখার বাধ্যবাধকতা থাকে।
সৈয়দ আবদুল হামিদ যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা সাধারণ চিকিৎসককেন্দ্রিক সেবাব্যবস্থা কীভাবে চলছে, তার বর্ণনা দেন। এরপর বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ইউনিয়ন হবে কেন্দ্র। এখানে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন ৮ জন। এর নিচে থাকবে কমিউনিটি ক্লিনিক, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন ৫ জন। কেন্দ্র খোলা থাকবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। স্বাভাবিক প্রসবসেবা পাওয়া যাবে ২৪ ঘণ্টা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্বে জনবল সমস্যা মেটানোর প্রস্তাব করেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ।
দেশের স্বাস্থ্যসেবায়, বিশেষ করে হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা সাধারণ চিকিৎসককেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা সভায় উপস্থিত সবাই স্বীকার করেন বা মেনে নেন। তবে মডেলটি ঠিক কী হবে বা কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে নানাজন ভিন্ন ভিন্ন মত দেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিসিটির ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ, ইনোভেশন, ইনকিউবেশন অ্যান্ড কমার্শিয়ালাইজেশনের পরিচালক অধ্যাপক খন্দাকার আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, তিনি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে দেশের ৬৫টি ইউনিয়নে একটি মডেল সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। এ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।
একাধিক আলোচক বলেন, দেশে এখন পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। ‘সাধারণ চিকিৎসক’ বা ‘জেনারেল প্র্যাকটিশনার’কেন্দ্রিক ব্যবস্থা বা জিপি ব্যবস্থা চালু করার এখনই উপযুক্ত সময়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, যুক্তরাজ্যে জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা জিপি ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ ছিল। জিপি ব্যবস্থা আছে, এমন প্রতিটি দেশের সরকারই চালু করেছে। এসব দেশে বড় বড় এনজিওর কোনো সংযুক্ততা ছিল না, দরকারও হয়নি। অর্থ যা লেগেছে, সরকারই দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এটা করতে চাই কি না। আমাদের আর তো কোনো বিকল্প নেই।’
জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা সাধারণ চিকিৎসককেন্দ্রিক ব্যবস্থার সুবিধা বর্ণনা করার সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল বলেন, এতে পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক সেবা দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হলে উপজেলা পর্যায়ে ৮০-৯০ শতাংশ রোগের সমাধান হবে। বাকি ২০ বা ১০ শতাংশ রোগীকে রেফার করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীর মোবারক হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে চিকিৎসক ধরে রাখা কঠিন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী প্রজ্ঞা পারমিতা রায় বলেন, জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা সাধারণ চিকিৎসককেন্দ্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় হওয়া প্রয়োজন। পাঠ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
প্রায় তিন ঘণ্টার এ আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল।