ডেঙ্গুতে ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু জানুয়ারিতে

চলতি জানুয়ারি মাসের তিন সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যতজন মারা গেছেন, তা আগের ২৪ বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। গত ২৪ বছরে এডিস মশাবাহিত এ রোগে জানুয়ারি মাসে আক্রান্তের গড় হারের চেয়ে এ মাসে ১৮ গুণ রোগী বেড়েছে। অতীতের যেকোনো জানুয়ারি মাসের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, ‘কার্যকর এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। গত বছরের ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়ানক দিক ছিল ঢাকার বাইরে উচ্চ সংক্রমণ। ডেঙ্গু যেভাবে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে গেছে, তাতে মাঠপর্যায়েও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ দরকার। যদিও এর জন্য জোর তৎপরতা দেখছি না।’

এখনো সময় আছে জোর প্রস্তুতি নেওয়ার। কিন্তু এবার যেমন ঢাকার দুই সিটিকে অনেক কাজ করতে হবে, ঢাকার বাইরেও নজর দিতে হবে। দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ এবং উন্নত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ডেঙ্গুর সমূহ বিপদ কমানো যেতে পারে।
বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬ জন এ রোগে আক্রান্ত হন। এ সময় মারা যান ৮৫৩ জন। তবে ডেঙ্গুর এসব রেকর্ড ভেঙে যায় গত বছর (২০২৩)। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা যান ৮৬৭ জন। গত বছর মোট মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের, আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি।

তবে প্রতিবছর দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুর প্রভাব কম থাকে। ডেঙ্গু সাধারণত বৃষ্টির মৌসুমে অর্থাৎ জুন মাসের দিক থেকে বাড়ে। মোটামুটি অক্টোবর মাস পর্যন্ত সংক্রমণের হার বেশি থাকে। ২০০০ সালের পর গত বছরের জানুয়ারিতেই প্রথম ডেঙ্গুতে ৬ জনের মৃত্যু হয়। তবে গতকাল (২৫ জানুয়ারি) পর্যন্ত এ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪ জন। এ সময় আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪৫ জন। আর ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জানুয়ারি মাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১০৮।

যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বলেন, গত ২৪ বছরে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে গড়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬ জনের বেশি। এ মাসে সেই গড়ের চেয়ে ১৮ গুণ মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এবার জানুয়ারিতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বড় সংক্রমণ ঝুঁকির বার্তা দিচ্ছে।

গত বছরের মোট আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ ছিলেন রাজধানীর বাইরের। এবার বছরের শুরু থেকেই বাইরে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের মধ্যে ঢাকার বাইরের ৫৯০ জন, ঢাকায় ৩১৭ জন। গত বছরের জানুয়ারি মাসে আক্রান্ত ৫৬৬ জনের মধ্যে ঢাকার বাইরের ২৯৪, ঢাকায় ২৭২।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বুঝতে লার্ভা বা শূককীট পরীক্ষা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এবার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দুই সিটিতে বিআই গত বছরের চেয়ে তিন গুণের বেশি।

গত বছরের শুরুতে ডেঙ্গুর মশার লার্ভা পরিস্থিতি দেখে ডেঙ্গুর বিপদ সম্পর্কে সরকারের দপ্তরগুলোকে সাবধান করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট নানা দপ্তরের গাফিলতির কথা বছরজুড়েই বলেছেন গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। এবার ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি আগের চেয়ে জটিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখনো সময় আছে জোর প্রস্তুতি নেওয়ার। কিন্তু এবার যেমন ঢাকার দুই সিটিকে অনেক কাজ করতে হবে, ঢাকার বাইরেও নজর দিতে হবে। দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ এবং উন্নত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ডেঙ্গুর সমূহ বিপদ কমানো যেতে পারে।