বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা

ভয় ও চাপের কারণে গণমাধ্যমে ‘স্ব–আরোপিত নিয়ন্ত্রণ’ চলে এসেছে

মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম থাকা জরুরি। তবে দেশের সাংবাদিকতা শতভাগ মুক্ত নয়। সাংবাদিকতায় পদ্ধতিগত অপরাধ ঘটছে। নানা আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের দমন, নিপীড়ন ও হয়রানি করা হচ্ছে। একধরনের ভয় ও চাপের মধ্যে থাকার কারণে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে ‘স্ব–আরোপিত নিয়ন্ত্রণ’ চলে এসেছে। অনেক ব্যবসায়ী–রাজনীতিবিদ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে নিজেদের স্বার্থে।

৩ মে ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। সেই উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

রাজধানীর গুলশান অ্যাভিনিউয়ে ইএমকে সেন্টারের কেনেডি হলে ‘প্রেস ফ্রিডম: ওভারকামিং চ্যালেঞ্জেস’ (মুক্ত গণমাধ্যম: চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণ) শিরোনামে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকেরা দেশের স্বার্থে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখার ওপর জোর দেন। আলোচনায় সাংবাদিকতায় নীতি–নৈতিকতা, সাংবাদিকদের কম পারিশ্রমিক পাওয়া, সাংবাদিকেরা মামলা–হয়রানি সম্মুখীন হলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের খোঁজ না নেওয়ার কথাও উঠে আসে।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ম্যাট ক্যানেল। তিনি বলেন, আইনের অপব্যবহারের কারণে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক দেশের সাংবাদিকদের ওপর নানা ধরনের আঘাত আসছে। তবে তিনি নিজ দেশের কথা তুলে ধরে বলেন, ব্রিটেনে আইনি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ। এ কারণে সাংবাদিকেরা যেকোনো প্রশ্ন তুলতে পারে। সরকার নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কারণ, নাগরিকেরা কর দেন।

সাংবাদিকদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য তুলে ধরে প্যানেল আলোচকদের মধ্যে আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক শহিদুল আলম বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে, অনেক সাংবাদিক নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। তাঁদের মনে হয়, কোনো পরিবর্তন হবে না, তাই কিছু বলে লাভ নেই। দেশে সাংবাদিকেরা এখন সাংবাদিকতা করছেন না। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোও যথাযথ সাংবাদিকতা করতে চায় না। সাংবাদিকেরা অনেক সময় লিখলেও প্রতিষ্ঠানগুলো তা প্রকাশ করে না। তারা নিজেদের স্বার্থ দেখে। তিনি বলেন, সাংবাদিকতা এখন দমনমূলক অবস্থায় আছে। সাহসী সাংবাদিকতা করতে ঝুঁকি নিতেই হবে।

ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, দেশে শতভাগ মুক্ত সাংবাদিকতা নেই। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে সাংবাদিকতাকে কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংবাদ পরিবেশন সংকুচিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, স্ব–আরোপিত নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে হননকারী। তরুণ সাংবাদিকদের এর মধ্যে না ঢুকে আরও বেশি করে সংবাদের সন্ধান করতে হবে।

প্রথম আলোর হেড অব কনটেন্ট (ইংরেজি ওয়েব) আয়েশা কবির বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামে এমন কিছু দমনমূলক আইন আছে, যার কারণে সাংবাদিকতা সব সময় ভয় ও চাপের মধ্যে থাকে। যে কাউকে যেকোনো সময় পথ থেকে তুলে নেওয়া হতে পারে। যে কারও পরিবার হয়রানির শিকার হতে পারে। এসব ভয় ও চাপের মধ্যে থাকার কারণে সাংবাদিকতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বনিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে। তিনি বলেন, সংবেদনশীল সরকারের উচিত মুক্ত গণমাধ্যমকে স্বাগত জানানো। মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম দরকার। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে জনগণেরও স্বাধীনতা, জনগণের অধিকার।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জনগণের কাছে জবাবদিহিও নিশ্চিত করে বলে মন্তব্য করেন প্রথম আলোর অপরাধ রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান রোজিনা ইসলাম। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, কোভিডের সময় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের যে ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর পরও তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে, তাঁকে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তাঁকে নিয়মিত আদালতে হাজির হতে হয়। পাসপোর্ট আটকে রেখে দেশের বাইরে তাঁর যাওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। যা মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।

অধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, একটি সংবাদ সম্মেলেন সাংবাদিকদের দুপুরের খাবারের প্যাকেটের মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার সংবাদ পড়ার পর এই মঞ্চে মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে কথা বলাই তাঁর জন্য কষ্টকর মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় পদ্ধতিগত অপরাধ হচ্ছে।

গত তিন মাসে ৮১ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকদের পাশে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের দাঁড়ানো, তাঁদের পুনর্বাসন করা, কিছু সময়ের জন্য দেশ বা দেশের বাইরে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া এবং সাংবাদিকদের মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি।

আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মার্কিন দূতাবাসের প্রিন্সিপ্যাল ডেপুটি মুখপত্র আশা সি বেহ। আলোচনার শুরুতে ‘মার্থা মিটচেল’ নামের প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।