মশার বিস্তার ঠেকানো এবং মশা মারার কার্যকর পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য দুই বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক। তাঁরা তখন বেশ কিছু সুপারিশ সিটি করপোরেশনকে দিয়েছিলেন। গবেষক দলটির সদস্যসচিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুকের সঙ্গে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক প্রণব বল।
প্রথম আলো: দুই বছর আগে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ে কাজ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতায় এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার কারণ কী?
ওমর ফারুক: ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় আমরা একটা গবেষণার কাজ চালিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, কোন ওষুধে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত দিক বজায় রেখে মশকনিধন কার্যকরভাবে করা যায়। নালা–নর্দমায় পানিপ্রবাহ যেখানে কম ছিল, সেখানে মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। সেই অবস্থার পরিবর্তন এখনো হয়েছে বলে মনে করি না, যার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এখন নালা–নর্দমা ভরাট হয়ে গেছে। তাতে পানির প্রবাহ নেই। পানির প্রবাহ যদি না থাকে, তাহলে তাতে মশা জন্মাবে। এর ফলে ডেঙ্গুও বাড়বে। বেড়েছেও।
প্রথম আলো: তখন মশার লার্ভা পেয়েছিলেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। এখন এডিসের বিস্তার আরও বেড়েছে বলে মনে করেন কি না?
ওমর ফারুক: অবশ্যই বেড়েছে। তখন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ৫৭টি স্থানে মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। হটস্পট ছিল ১৫টি। সম্প্রতি করপোরেশনের নিজস্ব একটা জরিপে দেখলাম, ৪৩৫টি স্থানে মশার প্রজননক্ষেত্র পাওয়া গেছে। অবশ্য ২০২১ সালে আমরা সবগুলো ওয়ার্ডে যেতে পারিনি। তবু বলা যায়, এখন সব জায়গায় মশার প্রজনন হচ্ছে। বিশেষ করে এডিস মশার বিস্তার বেড়েছে। নইলে এভাবে কেন ডেঙ্গু হানা দেবে!
প্রথম আলো: মশকনিধনের জন্য কী কী ওষুধের সুপারিশ আপনারা করেছিলেন? তা কতটা বাস্তবায়ন করেছে করপোরেশন?
ওমর ফারুক: আমরা তিনটি ওষুধ সুপারিশ করেছিলাম। তার মধ্যে একটি ছিল জৈব। ওই ওষুধটা অবশ্য সরকার অনুমোদিত নয় বলেছে। যার কারণে তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এখন করপোরেশন মশা মারতে যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে, তা আদৌ কার্যকর কি না, তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ, আমরা দেখেছি, ফগিং করলে মশা মরে না। স্প্রে করলে কিছুটা মরে। তাই ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা দরকার।
প্রথম আলো: সুপারিশের মধ্যে আর কী কী ছিল?
ওমর ফারুক: সুপারিশের মধ্যে নালা–নর্দমা পরিষ্কার রাখা, সচেতনতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে হটস্পটগুলোতে মশকনিধনে জোর দেওয়া, সামাজিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত ইত্যাদি অন্যতম। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া কিছু ঔষধি গাছ লাগানোর কথা ছিল, যেগুলোর গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। ওই সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। একধরনের মাছ পানির ওপরে দেখা যায়, যেগুলো লার্ভা খেয়ে ফেলে। আমরা জরিপ চালানোর সময়ও তা দেখেছি। ওই মাছগুলোও বিভিন্ন স্থানের নালা–নর্দমায় ছাড়ার সুপারিশ ছিল।
প্রথম আলো: আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এডিস মশার বিস্তার রোধে?
ওমর ফারুক: সবচেয়ে বেশি দরকার গবেষণা। মশা নিয়ে গবেষণা, এলাকাভিত্তিক জরিপ, তারপর কোন ওষুধে মশা বেশি মারা যাচ্ছে, এসব করতে হবে। চিরায়ত মশা মারার ওষুধ প্রয়োগের পাশাপাশি আধুনিক বিটি প্রযুক্তি বা আলট্রাসাউন্ড পদ্ধতির ব্যবহারও পাইলটিং ভিত্তিতে করা যেতে পারে। বিটি পদ্ধতি হচ্ছে একধরনের ব্যাকটেরিয়া নালায় ছেড়ে দেওয়া, যেখানে ওই ব্যাকটেরিয়া মশার লার্ভা ধ্বংস করে ফেলে। আলট্রাসাউন্ডও একধরনের শব্দপ্রযুক্তির মাধ্যমে লার্ভা ধ্বংস করে দেয়।
প্রথম আলো: সার্বিকভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় কী হতে পারে? এবার আগাম প্রস্তুতি নেওয়া কি যেত না?
ওমর ফারুক: অবশ্যই আগে থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। নেওয়া যেত। কিন্তু আমরা তা নিতে পারিনি। অথচ প্রতিবছর রোগটি হচ্ছে। এ জন্য মশকনিধন, নালা–নর্দমা পরিষ্কার করা অন্যতম। এ ছাড়া বাড়ির ছাদে, ফুলের টবে যাঁরা পানি রাখবেন, এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনে অভিযান চালাতে হবে। আর অবশ্যই সচেতনতার কাজটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।