প্রবীণ নিবাসে ঈদ

‘কে আসবে দেখতে, সবাই তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত’

ঈদের দিন। এই উৎসবেও কাছে পাননি পরিবারের সদস্যদের। প্রবীণ নিবাসের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দিনটি কেটেছে তাঁর
ছবি: প্রথম আলো

সোহেলী আক্তারের স্বামী মারা গেছেন ২০০৭ সালে। দুই মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন বিদেশে। নিরাপত্তা আর একাকিত্ব কাটানোর জন্য সোহেলী আক্তার ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে থাকছেন বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) প্রবীণ নিবাসে।

পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে সোহেলী আক্তারের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তবু ঈদ বলে কথা। তাই পরিপাটি করে একটি জর্জেট শাড়ি পরেছেন তিনি। লিপস্টিক দিয়েছেন। খেয়েছেন দুপুরে নিবাস কর্তৃপক্ষের পাঠানো পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস ও দই।

তবু ঈদের আমেজ অনুভব করতে পারছেন না সোহেলী আক্তার। বললেন, ‘কয়েক দিন আগে মেজ বোনের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। বড় বোন এখন দেশের বাইরে আছেন। আজ কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। আসার মতো কেউ তো নেই।

আমেরিকায় থাকা ছোট মেয়ে একবার ফোন করে বলল, সে গাড়ি চালাচ্ছে। বাচ্চাদের স্কুল আছে। শুধু একবার জানতে চেয়ে বলেছে, “ওহ্‌, আজ তো তোমাদের ওখানে ঈদ।”ব্যস্ততার জন্য মেয়েটা কথাই বলতে পারল না।’

সোহেলী আক্তার সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক। প্রবীণ নিবাসে তাঁর ঘরের টেবিলে নাতি-নাতনিদের ছবি। দেয়ালেও স্বামী ও নাতি-নাতনিদের ছবি। মেয়েরা ছোটবেলায় যে পুতুল নিয়ে খেলত, ফ্ল্যাট ছেড়ে আসার সময় সেগুলো নিয়ে এসেছেন, সাজিয়ে রেখেছেন ঘরে।

ঈদ উপলক্ষে পাইকপাড়ায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’-এ আয়োজন করা হয়েছিল বিশেষ খাবারের

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে দুপুরে কথা হয় সোহেলী আক্তারের সঙ্গে। সেখানে তিনিসহ ৩৬ জন নারী ও পুরুষ প্রবীণ থাকছেন। নিবাসটিতে দেখা গেল, প্রবীণেরা যে যাঁর ঘরে হয় পত্রিকা পড়ছেন, নয়তো নামাজ পড়ছেন। ঘুমানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছেন কেউ কেউ। নিবাস কর্তৃপক্ষের পাঠানো খাবার কেউ খেয়েছেন, আবার কেউ ছুঁয়েও দেখেননি।

নিবাসের ব্যবস্থাপক মহসীন কবির দুপুরে প্রবীণদের সঙ্গে দেখা করে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।

মহসীন কবির জানালেন, প্রবীণেরা ভাড়া দিয়ে এখানে থাকেন। তাঁদের অনেকের ভাড়া পরিশোধ করেন সন্তানেরা। ফলে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সন্তানেরা কয়েক মাসেও ভাড়া পরিশোধ করেন না। তখন নিবাসের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দিতে হয়। ঈদের দিনেও অনেক সন্তান নিজেরা না এসে লোক মারফত খাবার পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। কেউ কেউ এসে মা-বাবাকে নিয়ে যেতে চাইলেও দীর্ঘদিনের জমে থাকা অভিমানের কারণে তাঁরা ফিরে যেতে চান না।

হাসনা বানু কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। এক বছর হলো নিবাসে এসেছেন। এরই মধ্যে শৌচাগারে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন। একা কিছুই করতে পারেন না বলে দেখভালের জন্য একজন পরিচর্যাকারী রেখেছেন। হাসনা বানুর এক সন্তান জন্মের পর মারা যায়। এরপর আর সন্তান হয়নি। স্বামীও মারা গেছেন

রাজধানীর আজিমপুর গার্লস স্কুলে ৩১ বছর শিক্ষকতা করেছেন ফরিদা খাতুন। স্বামী মারা গেছেন। দুই ছেলে-মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ঈদের দিন কেউ দেখতে এসেছিলেন কি না জানতে চাইলে ফরিদা খাতুন প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করে জানতে চান, ‘কে আসবে দেখতে? সবাই তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।’

একসময় শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ নিয়ে বিশাল সংসার সামলেছেন ফরিদা খাতুন। পরিবারের সদস্যদের অনেকেই মারা গেছেন। ছেলে-মেয়েরা তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের কাছে রাখতে চান। কিন্তু ফরিদা খাতুনের সেখানে গিয়ে ‘দম বন্ধ’ লাগে। তাই দেশে যেতে না দিলে পুলিশে খবর দেবেন বলে হুমকি দিয়ে চলে এসেছেন।

অন্যদিন পোশাকের প্রতি ততটা নজর না দিলেও ঈদের দিন বলে একটি গোলাপি জামা পরেছেন ফরিদা খাতুন। নিবাসে থাকতে ভালো লাগে কি না জানতে চাইলে বললেন, ‘এখানে ভালো লাগালাগির তো কোনো প্রশ্ন নেই। বাধ্য হলে সবকিছুই করতে হয়।’

সোহেলী আক্তার প্রবীণ নিবাসে তাঁর ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন নাতি-নাতনিদের ছবি

নিবাসটির অনেকেই ঈদ নিয়ে কথা বলতে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। অনেকে পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি। একজন প্রবীণ নারী সালোয়ার–কামিজ ও মাথায় বড় ওড়না দিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হচ্ছিলেন। জানালেন, ভাইয়ের ছেলে সকালে এসে যেতে বলেছে। তাই ভাইয়ের ছেলের বাসায় যাচ্ছেন। তাঁর ছেলে-মেয়েরা এই শহরেই থাকেন। তাঁরা আজ এসেছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। ম্লান হাসি দিয়ে বললেন, ‘সব কথা জানতে হয় না।’

২০১২ সাল থেকে নিবাসে থাকা এক প্রবীণ পুরুষ জানালেন, সকালে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে মায়ের কবর জিয়ারত করে এসেছেন। স্ত্রী মারা গেছেন। এক ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। এর বেশি কিছু বললেন না। আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। তিনি জানালেন, ছেলে-মেয়েরা কোরবানি দিয়েছেন। তাঁরা হয়তো মাংস নিয়ে আসবেন, সে অপেক্ষাতেই আছেন।

প্রবীণ নিবাসের আরেক বাসিন্দা শিল্পী শেখ মুজিবুল হকের ঘরে তাঁর আঁকা বড় বড় ছবি। তবে শেষ কবে ছবি এঁকেছেন, তা আর এখন মনে নেই। তিন মেয়ে ও এক ছেলের কেউ আজ ফোন দেননি। ছেলে–মেয়েরা আসবেন কি না জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আসবে কি না, জানি না তো।’

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ অনুযায়ী, ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ। প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ রাজধানীর ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে ১৯৬০ সালে বাইগাম গড়ে তোলেন। বর্তমানে আগারগাঁওয়ে একটি হাসপাতাল ও পাশে একটি ভবনে এ প্রবীণ নিবাসের কার্যক্রম চলছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে বাইগাম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও বরাদ্দ দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মো. মোকতার হোসেন বর্তমানে বাইগামে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দুপুরে তিনি প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের দেখতে এসেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ঈদের দিনেও প্রবীণ নিবাসের সদস্যদের যদি একটু পোলাও-মাংস না খাওয়ানো যায়, তাহলে তাঁরা কষ্ট পাবেন। তাই প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে ৪০ হাজার টাকার সংস্থান করে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকার জেলা প্রশাসক প্রবীণ নিবাসের জন্য একটি গরু পাঠিয়েছেন।

এদিকে রাজধানীর মিরপুরে দক্ষিণ পাইকপাড়ায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের একটি নিবাসে থাকেন প্রতিবন্ধী শিশু ও প্রবীণ মিলে ১৭৩ জন। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার ২০১৪ সালে একজন অসহায় প্রবীণকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। তারপর মনের তাগিদে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখানে সবাই বিনা মূল্যে থাকছেন।

মিল্টন সমাদ্দার বললেন, ঈদের জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসক একটি গরু পাঠিয়েছেন। সাতজন শুভাকাঙ্ক্ষী মিলে আরেকটি গরু কিনে দিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জন ১৮টি ছাগল দিয়েছেন। ঈদুল আজহায় আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকেও ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। এই মাংস ফ্রিজে রেখে পরেও খাওয়ানো হবে প্রবীণ নিবাসীদের।

মিল্টন সমাদ্দার বললেন, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে শিশু ও প্রবীণ যাঁরা আছেন, সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা হয়েছে। ঈদের দিন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিবাসের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করা হয়েছে। তবে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিবাসীদের যে আক্ষেপ, তা তো আছেই। ঈদের মতো বিশেষ দিনেও কেউ তাঁদের দেখতে আসবে না, এটা তাঁরা মেনে নিতে পারেন না।