নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে অংশ নিয়ে নিবন্ধিত বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ইসি মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সাংবিধানিক বিষয়ে ইসির করণীয় কিছু নেই। নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ইসির অধীনে ন্যস্ত করার বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে ইসি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ আজ সোমবার প্রকাশ করেছে ইসি। ইসির পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছে। যেসব বিষয়ে ইসি পর্যবেক্ষণ বা মতামত দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা, ইভিএমের ব্যবহার, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, রাজনৈতিক মামলা, ইসির ক্ষমতা প্রয়োগ।
১০টি দল নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল সংলাপে।
গত ১৭ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডেকেছিল ইসি। এর মধ্যে বিএনপিসহ ৯টি দল ইসির সংলাপে যায়নি। ১০টি দল সংলাপে গিয়ে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। আর ১২টি দল নির্বাচনকালে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছিল। এসব দল গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয় সরাসরি ইসির অধীনে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল। আর বিএনপিসহ যে ৯টি দল সংলাপ বর্জন করেছে, তাদের কাছেও মূল বিবেচ্য বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার।
এবারের সংলাপে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে ইসি বলেছে, নিবন্ধিত সব দল বিশেষ করে প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করে তারা। তবে ইসি কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াসও তারা নেবে না। তবে সব দলকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে যাবে।
১২টি দল নির্বাচনকালে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছিল।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার প্রশ্নে ইসি বলেছে, ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি এবং সমর্থন দুই-ই রয়েছে। দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও ইভিএম নিয়েও তারা মতবিনিময় করেছে। কমিশন ইভিএমের বিষয়ে এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
অবশ্য গত রোববার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, সে সিদ্ধান্ত চলতি আগস্ট মাসের মধ্যে নেওয়া হবে। এর আগে কমিশন নিজেদের সক্ষমতা, কত ইভিএম আছে, প্রশিক্ষিত জনবল কত, কত টাকা ব্যয় হবে—এসব বিষয় বিবেচনা করবে। এরপর কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্ত আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
নির্বাচনের সময় সরকারি দলের মদদে গায়েবি বা মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেপ্তার বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব ছিল কয়েকটি দলের। এ বিষয়ে ইসি সরাসরি কোনো আশ্বাস দেয়নি। তারা বলেছে, কমিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চায়, সরকারি দল এ ধরনের নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনজনিত কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং রাজনৈতিক কারণে কোনো মামলা করে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করবে না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনকালে সব অংশীজনের কার্যকলাপ কমিশন গভীর পর্যবেক্ষণে রাখবে।
বিএনপিসহ যে ৯টি দল সংলাপ বর্জন করেছে, তাদের কাছেও মূল বিবেচ্য বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার।
জাতীয় নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন প্রশ্নে কমিশন বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব যৌক্তিক বলে মনে করে ইসি। তারা বলেছে, সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধানের অধীনে সব ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে ইসি সব উদ্যোগ নেবে। কারচুপির সম্ভাব্য সব সুযোগ প্রতিরোধ করে সঠিক ও নিরপেক্ষ ফল নিশ্চিত করতে সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ইসি কাজ করে যাবে।
ইসি বলেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা এবং অন্যান্য বিভাগ থেকে কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিষয়টি কমিশন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে। এ ছাড়া দেশি এবং বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভোট পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়া হবে। সামর্থ্য সাপেক্ষে ভোটকেন্দ্রের ভেতর সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার কথাও বলেছে ইসি।
ইসির পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ইসি যেসব মতামত বা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে, তা হতাশাজনক। অতীতে দেখা গেছে দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। গত কয়েক বছরে আরও বেশি দলীয়করণ হয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, বিদ্যমান কাঠামোতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটি কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন কমিশনের বলা উচিত ছিল।