বিকাশের প্রয়োজনেই শিকড়ের সন্ধান

সব্যসাচী হাজরা
সব্যসাচী হাজরা

বাংলা ভাষার প্রবাহে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, রাজনৈতিক লড়াই এবং একটি স্বাধীন মানচিত্রের স্বপ্নজয়। মাতৃভাষাচর্চার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কারণে একুশের অর্জন দেশ ও ভাষার সীমানা পেরিয়ে এখন বিশ্বপরিসরে। ফলে মাতৃভাষার চর্চা এবং এর রাজনৈতিক অধিকারের অভিব্যক্তি এখন আর আবেগের বিষয় নয়, অনেক বেশি দায়িত্বেরও।

‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’—নিজেদের বিকাশের প্রয়োজনেই তাই শিকড়ের সন্ধান। একুশের চেতনা একজন শিল্পী হিসেবে আমাকে সেই শিকড়ের সন্ধানে উৎসাহ জোগায়। আঁকাআঁকি, নকশা, প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে গ্রন্থনা, প্রকাশনা ও মুদ্রণ নিয়ে আমি যে যৎসামান্য কাজ করছি, সবকিছুর মূলে রয়েছে একই প্রেরণা।

শৈশব-কৈশোরে নলখাগড়ায় হাতেখড়ি, হাতে লেখা পুঁথি থেকে শুরু করে ব্যানার–ফেস্টুন, দেয়াললিখনের মধ্য দিয়ে বাংলালিপির অভিব্যক্তিকে উপলব্ধি করতে শিখেছি আমি। প্রচ্ছদ, অলংকরণ, নামলিপির সুবাদে ‘টাইপোগ্রাফি’ বা অক্ষরবিন্যাস আমার কাজের অনেকটা জুড়ে। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা টাইপোগ্রাফি নিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা এবং আমার অভিজ্ঞতাকে প্রকাশনা ও প্রদর্শনীতে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। একই অনুপ্রেরণা থেকে বাংলা ‘প্রাইমার’ বা শিশুশিক্ষার বই নিয়েও কাজ করছি। অন্যদিকে ২০২২ সালে অ: ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি শিরোনামের প্রকাশনায় প্রমিত লেখাঙ্কন শেখার করণকৌশল, বাংলা অক্ষরবিন্যাসের সম্ভাবনা আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে তুলে ধরেছি আমার অভিজ্ঞতা ও প্রস্তাব।

শৈশব-কৈশোরে নলখাগড়ায় হাতেখড়ি, হাতে লেখা পুঁথি থেকে শুরু করে ব্যানার–ফেস্টুন, দেয়াললিখনের মধ্য দিয়ে বাংলালিপির অভিব্যক্তিকে উপলব্ধি করতে শিখেছি আমি।

প্রতিটি ভাষায় ব্যবহৃত হরফের আদল বা চরিত্রে সেই অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশ, লোকজ শিল্পসংস্কৃতি, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকে। বাংলা হরফও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রযুক্তি ও যোগাযোগের উন্নতি বাংলা অক্ষরবিন্যাসের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে। কিন্তু বাংলা হরফ লেখাঙ্কনের (ক্যালিগ্রাফি) আনুষ্ঠানিক চর্চা নেই বললেই চলে, বাংলা টাইপফেস এখনো পরিণত হয়নি। বলপয়েন্ট কলম দিয়ে হাতেখড়ি যে প্রজন্মের, কি–বোর্ড তাদের কৈশোরের বাস্তবতা। হাতে লেখার প্রয়োজন ক্রমেই ফুরাচ্ছে। প্রমিত বাংলা হরফের সঙ্গে সংযোগ কমছে, অথচ টাইপোগ্রাফি নিয়ে কাজের পরিধি ও আবেদন বাড়ছে।

প্রমিত হরফের ওপর ভালো দখল ছাড়া এবং লেখাঙ্কনের অভিজ্ঞতা না থাকলে টাইপোগ্রাফি ও টাইপফেস নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজের ঝোঁক ও মান—দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা টাইপফেস তৈরি করতে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, আ-কার ই-কার, যুক্তবর্ণসহ প্রায় সাড়ে চার শ ক্যারেক্টার প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ব্যাপার।

বলপয়েন্ট কলম দিয়ে হাতেখড়ি যে প্রজন্মের, কি–বোর্ড তাদের কৈশোরের বাস্তবতা। হাতে লেখার প্রয়োজন ক্রমেই ফুরাচ্ছে।

অ: ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গেই ‘সব্যসাচী’ টাইপফেস আমি তৈরি করেছি, যা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। এই টাইপফেস বাংলা প্রমিত রূপের আদলকে ধরার চেষ্টা করেছে। বাংলা ভাষার শব্দের বিস্তার তথা টাইপফেসের ব্যবহার এত বিচিত্র যে তুলনামূলক অপ্রচলিত শব্দের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য পরীক্ষা করার জন্য বেশ খানিকটা সময় প্রয়োজন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাক্ষর–এর অনুপ্রেরণায় শিশুদের জন্য চিত্রলিপি নামের একটি বর্ণপরিচয় প্রকাশ করেছি ২০১৫ সালে। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহপাঠ্যক্রমে বইটি অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ বছর বাংলা প্রাইমার নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ এবং প্রদর্শনীর প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি, এই প্রকাশনা ও প্রদর্শনীটি বাংলা প্রাইমার নিয়ে নিরীক্ষাকে উৎসাহিত করবে।

‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’—মাতৃভাষাচর্চায় নিবিড় মনোযোগ একটি জাতির বহুমাত্রিক বিকাশ ত্বরান্বিত ও বলিষ্ঠ করে। বাংলা হরফচর্চায় আমার অকিঞ্চিৎ প্রয়াসের গন্তব্য তরুণদের সম্পৃক্ত করা। বাংলা হরফের নান্দনিক সম্ভাবনা তাঁদের উদ্দীপ্ত ও আত্মবিশ্বাসী করে এগিয়ে দিক আন্তর্জাতিক পরিসরে।

সব্যসাচী হাজরা: চিত্রশিল্পী; বাংলা হরফ নিয়ে কাজ করছেন।