‘মহব্বত থ্যাইক্যা সাহায্য করছি’

৫ জুলাই টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে এক প্রতিবন্ধী নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেন। প্রতিবন্ধী নারীর সন্তান জন্মদানে সাহায্য করেন উপজেলা সদরের বাওয়ার কুমারজানী গ্রামের বাসিন্দা মজিরন বেগম (৬৫)। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার কয়েকজন কর্মীর জন্য রান্নার কাজ করেন। তিন বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। তাঁর আট ছেলেমেয়ে। গতকাল শনিবার মজিরন বেগমের সঙ্গে তাঁর বড় ছেলের স্ত্রীর মুঠোফোনে কথা হয় প্রথম আলোর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজনীন আখতার

মজিরন বেগম
প্রশ্ন

কীভাবে প্রতিবন্ধী নারীর দেখা পেলেন?

মজিরন বেগম: সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বের হয়েছিলাম রান্নার কাজে যাওয়ার জন্য। তখন দেখতে পাই, স্কুলের কাছে জগ ও কলসি হাতে দুজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন। মাটিতে প্রসব যন্ত্রণায় এক প্রতিবন্ধী নারী চিৎকার করছেন। রক্ত ঝরছে। গায়ে সেভাবে পোশাক ছিল না।

প্রশ্ন

তখন আপনি কী করলেন?

মজিরন বেগম: আমি আগে দাইয়ের কাজ করেছি। সেই সময় দেখলাম, শিশুর মাথা বের হয়ে আসছে। আমি দুই নারীর সাহায্য চাইলাম। কিন্তু তাঁরা প্রতিবন্ধী নারীকে ধরতে চাইলেন না। আমি ধরতে গেলে ওই নারী (প্রতিবন্ধী) ধরতে দিচ্ছিলেন না। খামচি মারছিলেন। কোথা থেকে যেন আমার গায়ে এত শক্তি এসে ভর করল। একাই দুই পা দিয়ে নারীকে আটকে ধরে শিশু প্রসব করালাম।

প্রশ্ন

শিশুটি জন্ম নেওয়ার পর কেউ এগিয়ে এসেছিলেন কি?

মজিরন বেগম: শিশুটি প্রসবের পর নাড়ি কাটার দরকার হলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক লোককে বললাম দোকান থেকে একটা ব্লেড কিনে দিতে। ওই লোক দৌড়ে গিয়ে নিজের টাকায় ব্লেড কিনে আনলেন। স্কুল ঝাড়ু দেয় এমন দুই নারীকে বললাম একটা ন্যাকড়া দিতে। তাঁরা ন্যাকড়া এনে দিলেন। পরে নাড়ি কেটে ন্যাকড়া দিয়েই শিশুটিকে পরিষ্কার করলাম।

প্রশ্ন

শিশুটিকে আপনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন শুনলাম।

মজিরন বেগম: হ্যাঁ। শিশুটিকে পরিষ্কার করার দরকার ছিল। বাসা থেকে ওই জায়গা ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। ১০ টাকা দিয়ে একটা রিকশা নিয়ে শিশুটিকে সঙ্গে করে বাড়ি গেলাম। বড় ছেলের বউ পারুলের কাছে শিশুটিকে দিয়ে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য পেটিকোট, জামা ও ওড়না নিয়ে স্কুলের কাছে ফিরে এলাম।

প্রশ্ন

প্রতিবন্ধী নারী কোনো কথা বলেছিলেন কি?

মজিরন বেগম: নাম-পরিচয় কিছু বলতে পারেন না। ভাত খেতে চাইছিলেন বারবার। তখন আর ভাত কোথায় পাব? হাঁটিয়ে কাছের দোকানে নিয়ে গেলাম পাউরুটি-কলা কেনার জন্য। দোকানে তা ছিল না। দোকানদার ৫০ টাকা দিয়ে বললেন অন্য দোকান থেকে কিছু কিনে দিতে। দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকও ৫০ টাকা দিলেন। সেই টাকা দিয়ে অন্য দোকান থেকে পাউরুটি-কলা কিনে খাইয়ে, পোশাক পরিয়ে দোকানের বেঞ্চে শুইয়ে দিয়ে বাড়ি গেলাম।

প্রশ্ন

শিশুটিকে পরে কী করলেন?

মজিরন বেগম: বাসায় ফিরে শিশুটিকে নিয়ে মেম্বারের (ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য) বাসায় গেলাম। তাঁকে গিয়ে সব বললাম। তিনি থানায় যেতে বললেন। থানায় যাওয়ার পর পুলিশ বললেন ইউএনওর (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) কাছে যেতে। পরে ইউএনওর অফিসে যাওয়ার পর উনি ধন্যবাদ দিলেন। ওই প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুকে কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করলেন। শুক্রবার রাতে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। মা ও শিশু সুস্থ আছে।

প্রশ্ন

প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুকে সহায়তা করে নিশ্চয় আপনার ভালো লাগছে।

মজিরন বেগম: ভালো তো লাগছেই। এর আগেও আমি একবার এক নগ্ন প্রতিবন্ধী নারীকে রাস্তা থেকে বাসায় ধরে এনে গোসল করিয়ে, খাইয়ে, পোশাক পরিয়েছিলাম। প্রতিবন্ধী হলেও ওরাও মানুষ। আমি গরিব মানুষ হলেও যতটুকু পারি অন্যদের সাহায্য করি। মানুষের জন্য আমার অনেক দরদ। সেই মহব্বত থেকেই সাহায্য করেছি।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

মজিরন বেগম: আপনাকেও ধন্যবাদ।