মুক্তিযুদ্ধ এই সময়ে

মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার তাৎপর্য

মুক্তিযুদ্ধ জড়িয়ে আছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে। এটি আমাদের আগামীর দিকে ধাবিত হওয়ার স্বপ্নও দেখায়। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পেরিয়ে তার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারলাম আমরা? যুদ্ধ–পরবর্তী প্রজন্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজনের কলমে সেই ভাষ্য।

সেলিম রায়হান
সেলিম রায়হান

আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটা বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটা অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক মুক্তি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির সংজ্ঞা নিয়ে নানা ধরনের তর্কবিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি শোষণহীন সমাজ, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক প্রগতি ও উন্নতির কথা বলেছে। সামাজিক যে বৈষম্য আছে, সেগুলো দূর করাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল।

আমাদের প্রজন্মের কথা বললে, মুক্তিযুদ্ধের কাছাকাছি সময়েই আমার জন্ম। এই ৫০ বছরে—সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—অনেক দিক থেকেই আমরা হয়তো এগিয়েছি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের যে অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা, সেটির পূর্ণ বাস্তবায়ন থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে থেকে গেছি। বিশেষ করে, বৈষম্যহীন সমাজ অর্থাৎ যেখানে জনগণ অর্থনৈতিক উন্নতির সমগ্র সুফল পাবেন এবং জনগণের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে জবাবদিহি থাকবে—এই বিষয়গুলো এখনো অনেকটাই অপূর্ণ থেকে গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল, এখন সেগুলো আমরা কীভাবে বাস্তবায়িত করতে পারি। আমাদের কিংবা আমাদের পরের প্রজন্ম এই লক্ষ্যগুলো পূরণে কী কাজ করতে পারে?

একটা বিষয় পরিষ্কার যে গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেশ কিছু জায়গাতে আমাদের অনেক অর্জন আছে। আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেশ কিছু মানদণ্ডে—যেমন পরিপূর্ণভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য হ্রাস, শ্রমবাজারে ন্যায্য আয়ের কর্মসংস্থান তৈরি—আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এমনকি শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণে অগ্রগতি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলধারাতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কয়েকটি খাতে আমরা সীমাবদ্ধ আছি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বহুমুখীকরণের জায়গায় আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এই দিকগুলোতে আমাদের নজর দেওয়া উচিত, নয়তো মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা অর্জনে আমরা পিছিয়ে থাকব।

এটা ঠিক যে সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গত ৫০ বছরে বেশ কিছু জায়গায় উন্নয়ন হয়েছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুই খাতেই আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এ কথা সত্য যে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার আমরা কমিয়েছি। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত শক্তিশালী ভিত্তি হতে পারে। আমরা এখনো সে ভিত্তি গড়ে তুলতে পারিনি। জনমিতির যে লভ্যাংশের কথা আমরা বলি, তার সুফল পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। সেদিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।

সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় একটা দিক হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। এই বৈষম্যের দিকগুলোতে ঠিকভাবে নজর দেওয়া হয়নি। সে কারণে বৈষম্যের বহুমুখী চিত্র দেখা যাচ্ছে। শুধু আয়বৈষম্যই নয়, ভোগের, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি অঞ্চলভেদেও বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার সঙ্গে এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খুবই শক্তিশালীভাবে জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের দাবি তুলে ধরেছিল। গত ৫০ বছরে এই অঞ্চলের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা নানা ধরনের ওঠানামা দেখেছি, সামরিক শাসন দেখেছি, বেসামরিক শাসনেরও নানা ধরনের মডেল দেখেছি। আমরা জানি, কেবল নির্বাচনভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাই রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মানদণ্ড নয়।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের মতামতের কতটুকু প্রতিফলন হচ্ছে, জনগণের মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা-তর্কবিতর্ক করার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ কতটুকু প্রাণবন্ত হতে পারছে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে, সেগুলোরও বিবেচনা দরকার। সেই অর্থে জনগণের অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক—এই তিন জায়গা থেকে তাই মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমাদের এখনো অনেক কাজ করতে হবে। আমি আশা করব, আমাদের প্রজন্মের সদস্যরা অন্তত তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এবং যে যেখানেই আছেন, সেখান থেকে সামনের দিনগুলোতে কাজ করবেন।

তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে সঠিক ধারণার অভাব রয়েছে। কারণ, এসব নিয়ে খুব বেশি আলোচনা-তর্কবিতর্ক হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনাগুলো বাস্তবভিত্তিক না হয়ে খুব একপেশে হয়। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা বা লেখালেখি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান থাকবে এই বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা আরও বাড়ানোর জন্য।

আজকের সমাজে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করলে এ কথা বলতেই হবে যে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার মাধ্যমেই কেবল সেটি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য তাই এই চর্চার বিকল্প নেই।

ড. সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক; সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক।