তথ্যের বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ

ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছে মানুষকে। এর গভীর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী ইতিহাসে। এই আন্দোলনের আবেগ স্ফুরিত হয়েছে সাহিত্যে, গানে, চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে। কবিতা ও কথাসাহিত্য থেকে গবেষণা পর্যন্ত পৌঁছেছে এর প্রেরণা। এখানে রইল ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত একটি বইয়ের আলোচনা।

ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি জাতির রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নির্মাণ এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিরল এ ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতিগত ঐক্য, ভাষা ও সংস্কৃতিগত সাদৃশ্যের যে মানদণ্ড, তার তোয়াক্কা না করে শুধু ধর্মের দিকটি বিবেচনায় এনে ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করা হয় ভৌগোলিকভাবে ১২০০ মাইল দূরত্বের পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে। ফলে শুরু থেকেই বৈষম্যের শিকার হতে শুরু করে বাঙালিরা। এক উপনিবেশ থেকে আরেক উপনিবেশে গিয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার ভাগ্যের চাকা। প্রথম আঘাতটা আসে বাংলা ভাষার ওপর।

আবদুল মতিন ও আহমদ রফিকের ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নানা দিক উঠে এসেছে। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রচলিত যে ইতিহাস, তা খতিয়ে দেখেছেন দুই লেখক। দেখার চেষ্টা করেছেন কোন ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ আর কোনগুলো অতিরঞ্জিত। প্রচলিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে না থাকা অনেক অজানা বিষয় তুলে ধরেছেন এতে।

ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য

আবদুল মতিন আহমদ রফিক সাহিত্যপ্রকাশ, ঢাকা; প্রথম প্রকাশ: ১৯৯১

১৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বইয়ের শুরুতেই এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের বিষয় উঠে এসেছে। ভাষা আন্দোলনের সময়সীমা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত হলেও এই বই বলছে, দেশভাগের আগেও কেউ কেউ নতুন রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।

১৯৪৭ সালের ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক আবদুল হকের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়, ‘যে স্বাধীনতা আসছে, ভাষাগত স্বাধীনতা না পেলে তা হবে আংশিক এবং বদ্ধমুখ স্বাধীনতা।’ তমদ্দুন মজলিসই ভাষার অধিকারের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ এই প্রচলিত ইতিহাসকে এই বই তাই প্রশ্নের সম্মুখীন করে।

দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্রকাশিত প্রথম ডাকটিকিট, খাম, রেলটিকিটসহ সরকারি বিভিন্ন কাজে উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহার হলে অসন্তোষ দেখা দিতে শুরু করে মানুষের মধ্যে। তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে পুস্তিকা বের করে। তবে সে সময় কবি গোলাম মোস্তফা, মওলানা আকরম খাঁ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর মতো অনেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে উর্দুকে সমর্থন করেন।

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা দ্রুতই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। তমদ্দুন মজলিসও আপসের নীতি নেয়। শাসকগোষ্ঠী আবার বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ভাষা সংস্কার ও আরবি হরফে বাংলার প্রচলনের মতো ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

এ বইয়ে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি স্তর উঠে এসেছে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগের ও পরের আন্দোলনের বিস্তারিত তথ্য এখানে পাওয়া যায়। স্মৃতিচারণা, অতিকথন বা অতিশয়োক্তির কারণে এই পর্বের ইতিহাসের মধ্যে যেসব বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, সেগুলো সরিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এ বইয়ে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে আন্দোলনের ভেতরের নানা অজানা বিষয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন যে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল, এই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে বইটি নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহীসহ নানা অঞ্চলের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে তুলে ধরেছে।

ভাষা আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস জানতে হলে বইটি অপরিহার্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক।