বাংলাদেশে বার্ধক্য একটি ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বাংলাদেশে সব বয়স্ক ব্যক্তির পূর্ণ মানবাধিকার নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা এখনো বাকি আছে। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সমতা-বৈষম্যহীনতার নীতি কার্যকরে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়ন করা দরকার।
বয়স্ক ব্যক্তিদের মানবাধিকার ভোগবিষয়ক জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ ক্লাউডিয়া মালার এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছেন। সরকারের আমন্ত্রণে গত বছরের নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। এই সফরের আলোকে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়েছেন। প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছেন তিনি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ২০২০ সালের মে মাসে ক্লাউডিয়া মালারকে এই দায়িত্বে নিযুক্ত করে। তিনি তাঁর প্রতিবেদনে নানামুখী চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বয়স্ক ব্যক্তিদের মানবাধিকার ভোগের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ও প্রতিশ্রুতির কথা স্বীকার করেন। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালাসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান এ-সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি-নীতি কাঠামোকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।
তবে জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, বাংলাদেশে বয়স্কদের দারিদ্র্য এখনো প্রবলভাবে রয়ে গেছে। চাকরিতে আছে বয়সভিত্তিক বৈষম্য। বয়স্কদের জন্য যথাযথ সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার অভাব আছে। বৃদ্ধ বয়সে প্রত্যেকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও জরুরি পদক্ষেপ দরকার। বয়স্ক ব্যক্তিদের শুধু অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকারই নয়, তাঁদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে আরও জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ তাঁর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—
* বয়স্কদের মানবাধিকারসংক্রান্ত যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি ও ঐচ্ছিক প্রোটোকল এখনো বাংলাদেশ সই করেনি, সেগুলো অনুমোদন করা।
* জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়নে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি সময়ভিত্তিক ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করা। এই নীতিমালার বাস্তবায়ন নিরীক্ষণে একটি নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা।
* বয়স্ক নারীদের প্রতি বৈষম্যকারী সব আইন ও বিধান বাতিল করা। এর মধ্যে উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির অধিকার ক্ষুণ্নের আইনও অন্তর্ভুক্ত।
* বয়সকে অবশ্যই বৈষম্যের একটি কারণ হিসেবে আইনগতভাবে চিহ্নিত করা। এ রকম বৈষম্য নিষিদ্ধ করা।
* বয়সসংক্রান্ত গৎবাঁধা-ভুল ধারণার বিস্তার বন্ধে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবিলায় আইনি সুরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা।
* স্বাস্থ্য ও সেবাসংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের জন্য বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
* আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতা-হয়রানি ছাড়াই বয়স্ক ব্যক্তিদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সমুন্নত রাখা।
* আরও বেশি বয়স্ক ব্যক্তি যাতে বয়স্ক ভাতা পান, তা নিশ্চিতে বাজেটে অগ্রাধিকারে পরিবর্তন আনা। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিতে প্রতি মাসে ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা।
* সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩ সংশোধন করা। আইনটি এমন হতে হবে, যাতে বয়স বা অবদানের সময়কাল নির্বিশেষে সব বয়স্ক ব্যক্তি এই স্কিম থেকে উপকৃত হন।
* নতুন পেনশনব্যবস্থা ও ভাতা সম্পর্কে বয়স্ক ব্যক্তিদের জানানোটা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবস্থাটি সহজ ও বয়সবান্ধব হতে হবে।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের কাজ করার অধিকার, শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের দারিদ্র্য কমাতে তাঁদের নিজস্ব আয়মূলক কার্যক্রম শুরু করতে সহায়তার জন্য ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা চালু করা।
* বয়স্কসহ জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ বাধ্য। জাহাজভাঙা শিল্পে নিয়োজিত বয়স্ক শ্রমিকদের মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করা।
* মা–বাবার ভরণপোষণ আইনটিকে (২০১৩) মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন ও আইনগতভাবে সংশোধন করা। এ ক্ষেত্রে বয়স্ক ব্যক্তিদের চাহিদা ও অধিকারকে বিবেচনায় নেওয়া।
* একাকিত্ব-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলায় বয়স্ক ব্যক্তিদের সমিতি ও আন্তপ্রজন্মমূলক স্বসহায়ক ক্লাব তৈরিতে আর্থিকভাবে সহায়তা করা।
* সব বয়স্ক ব্যক্তির জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
* জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের ওপর কার্যক্রম চালু করা। সারা দেশে জেরিয়াট্রিক ইউনিট ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা।
* জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশল ও কার্যক্রমে বয়স্ক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা। স্মৃতিভ্রংশের (ডিমেনশিয়া) সমস্যাটিকে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।
* গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয় হোম কেয়ার প্রোগ্রাম ও কমিউনিটিভিত্তিক যত্ন পরিষেবা প্রতিষ্ঠা করা।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিতের জন্য জরুরি ও অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ।
* দুর্যোগে সাড়া দেওয়ার পরিকল্পনার মূল্যায়ন, প্রস্তুতি, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ-কার্যকরভাবে পরামর্শ করা।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের বসবাস স্থলের কাছাকাছি প্রবেশযোগ্য, বয়স-লিঙ্গ-সংবেদনশীল আশ্রয়কেন্দ্র করা।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা ও শহুরে অনানুষ্ঠানিক বসতিতে (বস্তি) বসবাসকারী বয়স্কদের পর্যাপ্ত, নিরাপদ, সাশ্রয়ী বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা।
* বয়স্ক ব্যক্তিদের, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক বসতিতে (বস্তি) বসবাসকারী বয়স্কদের উচ্ছেদ থেকে রক্ষা করা।
* বিচারপূর্ব প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির বয়স, বিশেষ করে বার্ধক্যের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া। বিচারপূর্ব আটকের সময়কাল যতটা সম্ভব কমানো।