অনেক শিক্ষার্থী সব বই পায়নি

মাধ্যমিকে ৫০ লাখের বেশি বইয়ের ছাড়পত্র হয়নি। অনেক জায়গায় বই গেলেও বিতরণ সমস্যায় সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই যায়নি।

  • এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।

  • নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় তিনটি শ্রেণিতে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হয়েছে।

  • বইয়ের মানও অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ বলে অভিযোগ উঠেছে।

নতুন বই পাওয়ার আনন্দে মেতেছে ভেদভেদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা। রাঙামাটি, ৪ জানুয়ারি।

রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চবিদ্যালয়ে এ বছরের শুরু থেকে সব শ্রেণিতেই ক্লাস চলছে। তবে একাধিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখনো সব বই পায়নি।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হয় একজন শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি জানান, ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সব বই পাওয়া গেছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি বইয়ের মধ্যে তিনটি বই পেয়েছেন। সেগুলো হলো—বাংলা, ইংরেজি এবং ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী বই। আর অষ্টম শ্রেণির জন্য আটটি বই পেয়েছেন। পাঁচ-ছয়টি বই এখনো পাননি।

তবে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় অবস্থিত খোদেজা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, এই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পেয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁরা আশা করছেন ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পেয়ে যাবে।

যদিও প্রথম আলোর পক্ষ থেকে রাজধানীসহ পাবনা, গাইবান্ধা, ভোলা, জামালপুর, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সরেজমিন গিয়ে এবং ওই সব এলাকার শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসের শেষ দিন গতকাল পর্যন্ত সব শ্রেণির সব শিক্ষার্থী বিনা মূল্যের নতুন বই হাতে পায়নি।

এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বই। ভালো মানের মণ্ডের সংকটসহ কিছু কারণে এবার সময়মতো সব শিক্ষার্থীর হাতে মানসম্মত সব বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। বছরের শুরুতে স্কুলে স্কুলে উৎসব করা হলেও এখনো সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি। আবার বইয়ের মানও অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বই ছাপাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৫০ লাখ ২৩ হাজারের বেশি বই ছাপা বা ছাপার পর উপজেলা পর্যায়ে পাঠাতে ছাড়পত্র হয়নি। তবে প্রাথমিকের সব বইয়ের ছাড়পত্র হয়েছে। তাঁরা জানতে পেরেছেন, অনেক উপজেলায় বই গেলেও বিতরণ পর্যায়ে এসে অনেক বিদ্যালয়ে বই যায়নি। এমনকি ঢাকাতেও এমন ঘটনা আছে। তবে অতি শিগগির এই সমস্যাও দূর হয়ে যাবে।

এবার প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেক জায়গায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বই গতকাল পর্যন্ত হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে সপ্তম শ্রেণিতে এই সমস্যা বেশি হচ্ছে। যেহেতু এই শ্রেণিগুলোর বইগুলো একেবারে নতুন, তাই সব নতুন বই হাতে না পাওয়ায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অসুবিধা হচ্ছে। পুরোনো শিক্ষাক্রমের সব বইও অনেক জায়গায় সব শিক্ষার্থীর হাতে যায়নি।

সরেজমিন চিত্র

গতকাল সকালে জামালপুর সদরের বঙ্গবন্ধু স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জামালপুর উচ্চবিদ্যালয়, সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও বানিয়াবাজার উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থী যতগুলো বই পাওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে কম বই পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, সে চারটি বই পেয়েছে। বই কম থাকায় ক্লাসও কম হচ্ছে।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার নতুন বইয়ের চাহিদা হচ্ছে ৪৮ লাখ ৬২ হাজার ৩৩২টি। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭২টি।

সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. সামছুল হক বলেন, শুধু ষষ্ঠ শ্রেণির সব বই পাওয়া গেছে। সপ্তম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের সব বই এখনো পাওয়া যায়নি।

অবশ্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকে ৯৫ শতাংশ বই বিতরণ করা হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলার শিক্ষা বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, গাইবান্ধা জেলায় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক মিলে মোট বই দরকার প্রায় ৬০ লাখ। কিন্তু পাওয়া গেছে ৪১ লাখ ৭৩৪টি।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি উচ্চবিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, এখনো সব বই তাঁদের বিদ্যালয়ে যায়নি।

গতকাল সকালে পাবনা জেলা শহরের কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পৈলানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও প্রভাতী পরিষদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বিদ্যালয়েই ক্লাস চলছে। তবে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে পুরোনো বই।

এই তিন বিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব নতুন বই পেয়েছে। তবে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, বিজ্ঞান ও ধর্ম বই পায়নি। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পায়নি বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান ও ধর্ম বই। ফলে এসব শ্রেণিতে পুরোনো বই দিয়ে ক্লাস চালানো হচ্ছে।

প্রভাতী পরিষদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবেদা আক্তার জানান, নতুন বই পেলে পুরোনো বইগুলো ফেরত নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে ৬৫ শতাংশ নতুন বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাকি বইগুলোও আসছে।

ভোলা সদর উপজেলায় প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৬ হাজার। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে দু-একটি করে বই দেওয়া গেলেও এখনো প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থী বই পায়নি।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের ২৩টি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির গণিত, ধর্ম, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা বিষয়ের বই যায়নি। আর ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শাখার বিষয়ভিত্তিক কোনো বই যায়নি। সপ্তম শ্রেণির ইসলাম ধর্ম এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ের বই যায়নি।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলায় প্রথম শ্রেণির ৭ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থীর জন্য শুধু ইংরেজি বই গেছে। বাংলা ও গণিত বই এখনো পৌঁছায়নি।

গতকাল সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের দিলু রোড এলাকার প্রভাতী উচ্চ বিদ্যানিকেতনে গিয়ে জানা গেল, এই বিদ্যালয়ে এখনো সব শ্রেণির সব বই হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা। অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী জানাল, তারা এখনো সব বই হাতে পায়নি। পরে প্রধান শিক্ষক নাহিদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অষ্টম শ্রেণির মেয়েদের শাখায় পাঁচটি করে এবং ছেলেদের শাখায় ছয়টি করে বই এসেছে। বাকি বই এখনো পাওয়া যায়নি।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি গাইবান্ধা, পাবনা, ভোলা, জামালপুর, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা]