রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নষ্ট রেডিওথেরাপি (বিকিরণ চিকিৎসা) যন্ত্র দুই সপ্তাহেও সচল হয়নি। এমনকি বিশেষায়িত এই হাসপাতালের এক্স–রে ও এমআরআই যন্ত্রও নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
যেকোনো সাধারণ হাসপাতালে বা ছোট ক্লিনিকেও আজকাল রোগীদের এক্স-রে করা হয়। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় এই ক্যানসার হাসপাতালে কোনো এক্স-রে হয় না। এক্স-রের প্রয়োজন হলে বাইরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে করতে হয়।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে নষ্ট যন্ত্রের উদাহরণ আরও আছে। আধুনিক চিকিৎসার জন্য যেকোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে বা বড় হাসপাতালে আজকাল এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং) যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। চুম্বক শক্তি ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুর খুঁটিনাটি তথ্য–সংবলিত প্রতিচ্ছবি তৈরি করে এমআরআই যন্ত্র। ক্যানসার রোগীদের জন্য যন্ত্রটির প্রয়োজন আছে। কিন্তু হাসপাতালের একটিমাত্র এমআরআই যন্ত্র বহুদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
‘ক্যানসার হাসপাতালটি যেন ক্যানসারে আক্রান্ত। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে হাসপাতালকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এটি সহজে নিরাময় হওয়ার নয়।’আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ পরিস্থিতি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবু নোমান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্র খারাপ হওয়ায় গত নভেম্বর থেকে এক্স-রে বন্ধ আছে।
তবে হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা বলেছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে এক্স-রে যন্ত্রে সমস্যা চলছিল। এক দিন চলত তো এক সপ্তাহ বন্ধ থাকত। নভেম্বর থেকে তা একেবারে বন্ধ।
এমআরআই যন্ত্রের বিষয়ে আবু নোমান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী জানিয়েছেন, যন্ত্রটি এক বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে।
মনোয়ারা বেগম (ছদ্মনাম) ভুগছেন স্তন ক্যানসারে। বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে আট মাস আগে। চিকিৎসকেরা তাঁকে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসে রেডিওথেরাপি (বিকিরণ চিকিৎসা) নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রায় আট মাস ঘুরে মনোয়ারা বেগম গত সপ্তাহে থেরাপি নেওয়ার তারিখও পেয়েছিলেন। কিন্তু নিতে পারছেন না। কারণ, সব যন্ত্র নষ্ট।
গতকাল সকালে জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে কথা হয় মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাবা, আমার একটা ব্যবস্থা করে দাও। আমি কত দিন ঘুরব। কী খাব, কোথায় থাকব, কোনো হদিস পাচ্ছি না।’
মনোয়ারা বেগমের বাড়ি পটুয়াখালীর একটি চরে। ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখন জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের বারান্দায় বা সিঁড়ির নিচে রাত কাটান। কত দিন এভাবে চলবে বুঝে উঠতে পারছেন না।
শুধু মনোরায়া বেগম নন, রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য আরও ১০–১৫ জনকে হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। তাঁদের অন্তত ৫ জন বলেছেন, হাসপাতাল থেকে তাঁদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রেডিওথেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুটি হাসপাতালের নামও তাঁরা বলেছেন।
দেশের সবচেয়ে বড় এই ক্যানসার হাসপাতালের রেডিওথেরাপির ছয়টি যন্ত্রই নষ্ট। এর মধ্যে দুটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র ও দুটি কোবাল্ট যন্ত্র একেবারে পরিত্যক্ত। একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র মেরামতের জন্য পড়ে আছে। বাকি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্রটি মেরামতের জন্য প্রকৌশলীদের গতকাল ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন দ্রুত যন্ত্রটি ঠিক করার।
রেডিওথেরাপির জন্য লিনিয়ার এক্সিলারেটরকে ক্যানসার চিকিৎসায় আধুনিক যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কম্পিউটারের সাহায্যে এই যন্ত্র দিয়ে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণে বিকিরণ দেওয়া হয়। একটি যন্ত্র দিয়ে দিনে ১২০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। চারটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র কেনা হয়েছে ১৯৯৯ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে। গতকাল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবু নোমান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সর্বশেষ যন্ত্রটি কেনা হয় ১৭ বছর আগে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রেড ভিশন নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই চারটি যন্ত্র সরকারের কাছে বিক্রি করেছিল। ট্রেড ভিশনের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে মুঠোফোনে খুদে বার্তায় জানিয়েছেন, এক বছর আগে তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগে তাঁরা বারবার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন যেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের কথা শোনেনি। মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সব যন্ত্র ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন নতুন যন্ত্র কিনতে চাইছে।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, নতুন দুটি যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গতকাল তাঁকে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ–ই–মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘যন্ত্রের কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সরকারি হাসপাতালে গড়ে তোলা হয়নি। যন্ত্র নষ্ট হয়, নাকি নষ্ট করে রাখা হয়, তা নিয়ে সন্দেহ অনেক পুরোনো। নতুন যন্ত্র কিনলে কমিশনের বিষয় থাকে, তাই তাতে অনেকের আগ্রহ থাকে।’
রাজধানীর মহাখালীর এই জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালটি ৫০০ শয্যার। গড়ে হাসপাতালের ৯০ শতাংশ শয্যায় রোগী থাকে। কোনো কোনো বিভাগে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় রোগীদের হাসপাতালের বারান্দায় বা সিঁড়ির নিচে থাকতে দেখা যায়। হাসপাতালের ভেতরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় রোগীদের রাস্তায় থাকার ছবিও গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে।
এ ছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। সারা দেশের দরিদ্র ক্যানসার রোগীদের এটাই প্রধান ভরসার জায়গা। এখানে কম মূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায়। এই হাসপাতালে এক দফা রেডিওথেরাপি নিতে খরচ হয় ২০০ টাকা। একই চিকিৎসা বেসরকারি হাসপাতালে নিতে খরচ হয় চার থেকে আট হাজার টাকা।
হাসপাতালটির এই অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যানসার হাসপাতালটি যেন ক্যানসারে আক্রান্ত। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে হাসপাতালকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এটি সহজে নিরাময় হওয়ার নয়।’