বিশেষ লেখা

ব্যাকস্পেস থেকে মুক্তি চাই

শনিবার বিকেল–এর একটি দৃশ্য
শনিবার বিকেল–এর একটি দৃশ্য

১ জুলাই ২০১৬। ইফতারের ঠিক আগে আগে মনে হলো বাইরে খাব আজকে। গাড়ি নিয়ে বের হলাম। আমার সঙ্গে আমার সহকারী পরিচালক রেজা। ড্রাইভারকে বললাম গুলশান ২-এর দিকে যেতে। একটা ক্যাফেতে ঢুকলাম। মেনু ঘেঁটেঘুঁটে বের হয়ে গেলাম। ড্রাইভারকে নতুন নির্দেশনা দিলাম। রোড ৭৯-এ চলো। হোলি আর্টিজানের ব্রেড ভালো। চোখ চলে গেল পশ্চিম আকাশে। এক অদ্ভুত বিষণ্ন আকাশ। রেজাকে বললাম, চলো, ঢাকা ক্যান্ট. স্টেশনে যাই। খোলা জায়গা আছে। আকাশটার ছবি তুলতে ইচ্ছা করছে। চলে গেলাম স্টেশনে। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলাম একটা মন খারাপ করা ক্যাপশন দিয়ে। ও রকম আকাশ আমাদের থমকে দিয়েছিল। বিষণ্ন আকাশ সেদিন আমার জীবনের পথ বদলে দিল।

কয়েক ঘণ্টা পরেই জানতে পারলাম হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমি ঠিক বলতে পারব না আমি কেমন অনুভব করছিলাম। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে যাওয়ায় বেঁচে থাকার আনন্দই বোধ করা উচিত। কিন্তু উল্টো আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। মনে হলো, সেই ক্যাফের ভেতরে আটকে থাকা মানুষদের আমিও একজন। ভাবনাটা আমাকে এক ভয়ংকর ট্রমার ভেতর নিয়ে গেল। ট্রমা থেকে বের হওয়ার একটাই রাস্তা আমার জানা আছে, সেটা হলো শিল্পের মধ্যে এর মোকাবিলা করা। সেই তাগিদে আমি বানালাম শনিবার বিকেল। সিনেমাটি এ ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত, ঘটনাটির পুনর্নির্মাণ নয়। আমার ছবিতে ক্যাফেতে আটকে পড়া সত্যিকারের কোনো চরিত্রই নেই। চরিত্র কাল্পনিক। কারণ, আমার রিপোর্টিং অভীষ্ট নয়। আমার অভীষ্ট কল্পনার একটি জগৎ বানিয়ে গভীরতর সত্যকে খোঁজা, একটি দার্শনিক অবস্থানে পৌঁছানো।

দুর্ভাগ্য হলো, ছবিটা আমাকে আরও বড় ট্রমার ভেতর আটকে ফেলল। আমার জীবনটাকে ব্যাকস্পেসময় করে তুলল। আজ সাড়ে তিন বছর শনিবার বিকেল আটকে আছে সেন্সর বোর্ডে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি এই সাড়ে তিন বছরে কী রকম ভীষণভাবে বদলে গেছি আমি। আমার হাতের দিকে তাকাই, একই রকম আছে। আমার চোখের দিকে তাকাই, একই রকম আছে। আমার মুখের দিকে তাকাই, একই রকম আছে। কিন্তু তবু যেন আমাকে আমি চিনতে পারি না। আমি বুঝতে পারি, আমার বুকের ভেতর একটা নতুন অরগান বেড়ে উঠেছে গোপনে। কর্কট রোগের চেয়েও ভয়ংকর। ব্যাকস্পেস (আড়ালে থাকা অদৃশ্য এক পৃথিবী) নাম তার। আমি কিছু লিখতে যাই, ব্যাকস্পেস তৎপর হয়ে যায়। আমি কিছু ভাবতে যাই, ব্যাকস্পেস আমার হয়ে ভাবে। আমি ঘুমাই, ব্যাকস্পেস জেগে থাকে।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

আমি তো স্রেফ একটা গল্পই বলতে চেয়েছি। এই জল-হাওয়া-মাটিতে বেড়ে উঠে আমি এই মাটির বেদনায় বেদনার্ত হব না? প্রশ্ন করব না, আমরা কীভাবে এখানে এলাম? হয়তো উত্তর খুঁজে বের করার সাধ্য আমার নেই, কিন্তু প্রশ্ন তো করতে পারব। শিল্পের কাজই তো প্রশ্ন তোলা।

শনিবার বিকেল শুটিং শুরু করার আগে বিধিমোতাবেক তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে বিদেশি শিল্পী ও কারিগরি টিম আনার অনুমতি চাইতে হয়েছিল। তখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন হাসানুল হক ইনু। আমাকে অনুমোদন দেওয়ার আগে সেই পাণ্ডুলিপি দায়িত্বশীল মহল নিশ্চয়ই পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে দায়িত্ববান একজন ভূয়সী প্রশংসা করে এও বলেছেন, এটা খুব প্রয়োজনীয় গল্প। ছবি বানানো হয়ে যাওয়ার পর সেন্সর বোর্ডের কেউ কেউ প্রথম স্ক্রিনিংয়ে ছবির প্রশংসা করে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন, দ্রুত সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। তারপর কোন ইশারায় যেন ছবিটি আটকা পড়ে গেল। আমাদের চিঠিতে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ না করে বলা হলো, এই ছবির কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, ধর্মীয় অস্থিরতা তৈরি হবে ইত্যাদি। আর কাছাকাছি সময়ে হলিউড রিপোর্টার পত্রিকার রিভিউতে লেখা হলো, ‘ছবিটা আটকে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায়। অথচ ছবিটা দেখে আমাদের উপলব্ধি হলো, ছবিটা যদি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পারে, সেটা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ানো।’

কিছুদিন আগে আমরা নির্মাতা, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী—সবাই মিলে একজোট হয়ে বললাম, ‘গল্প বলার স্বাধীনতা চাই।’ আমাদের একটা প্রতিনিধিদল তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের আমন্ত্রণে তাঁর বাসায় যায়। সেখানে তিনি বলেন, শনিবার বিকেল ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিছু জিনিস সংযোজন করলে এটা দ্রুত ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি ‘কিছু জিনিস’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, সেটা জানতে। কারণ, শনিবার বিকেল একটি এক শটে চিত্রায়িত চলচ্চিত্র। এতে সামান্য কোনো দৃশ্য সংযোজন বা বিয়োজনেরই কোনো সুযোগ নেই। তবে দৃশ্য সংযোজন না করে অন্যভাবেও ধারণার সংযোজন ঘটানো যেতে পারে। সেন্সর বোর্ডের চিঠি হাতে পেলে আমরা বুঝতে পারব ছবির কোনো ক্ষতি না করে সেটা কীভাবে আমলে নেওয়া যায়।

তাত্ত্বিকভাবেও সেন্সর বোর্ড কোনো দৃশ্য সংযোজন করতে বলতে পারে না। তাহলে তো তারাই ছবির চিত্রনাট্যকার হয়ে ওঠে। শিল্পী তাঁর নিজের চিত্রনাট্য নিজেই লিখবেন। কিংবা অন্য কেউ কেবল তাঁর অন্তর্দৃষ্টি অনুসরণ করেই লিখে দিতে পারবেন। পৃথিবীর আর কেউ সেটা পারে না। কোনো ব্যাকস্পেস তার হয়ে চিন্তা করবে না।

বাংলাদেশে গত ১৫-২০ বছর ধরে অল্প অল্প করে চলচ্চিত্রের ভাষা বদলে চলেছে। তার ধারায় আমাদের এখানে অনেক আকর্ষণীয় নির্মাতা কাজ করছেন। সামনে আরও অনেকে আসছেন যাঁদের হয়তো আমরা এ মুহূর্তে চিনিও না। নানা রকম ছবি উপভোগ করতে পারার মতো বড় একটা দর্শকশ্রেণিও তৈরি হয়ে উঠছে।

আমাদের এখন শুধু দরকার একটা কাজের পরিবেশ, যেখানে আতঙ্ক আমাদের তাড়া করবে না। ২০১৬ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে দাঁড়িয়ে যে বিষণ্ন আকাশ আমি দেখেছি, সে আকাশ বদলে যাক। আমরা দ্রুত শনিবার বিকেল–এর সেন্সর সার্টিফিকেট চাই। গল্প বলার ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হোক। নীতিমালা সংস্কার করা হোক। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য সরকার অংশীজনদের কথা শুনবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে।

শেষ করতে চাই সেন্সর প্রথার সংস্কার বিষয়ে কিছু কথা বলে। উপনিবেশ আমলে সেন্সর প্রথা চালু করা হয় প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। স্বাধীন দেশে তো এর কোনো প্রাসঙ্গিকতাই থাকতে নেই। সরকারের উচিত অবিলম্বে গ্রেডেশন প্রথা চালু করা। রেটিং অনুযায়ী যে ছবি যে বয়সের দর্শকের উপযোগী, সেটা সে বয়সের দর্শক দেখবে। চলচ্চিত্র বা শিল্প–সাহিত্যের কারণে ভাবমূর্তি নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

প্রতিদিন লাখ লাখ ভিডিও টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউবে আপলোড হচ্ছে এবং নানা দেশ থেকে। কোনো বাধা ছাড়াই সেসব প্রচারিতও হচ্ছে। এই উন্মুক্ত প্রযুক্তির যুগে আদৌ কি এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? এ সময় অহেতুক সিনেমার পেছনে ছুটে আদৌ কোনো লাভ হচ্ছে কি না, তা ভাবার সময় এসেছে। অযথা এই ‘ভাবমূর্তি’র পেছনে ছুটে অহেতুক শুধু শিল্পীদেরই হয়রানি করা হবে না, দেশ আর সমাজেরই বিপুল ক্ষতি করা হবে।

  • মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা