শীতে ইউরোপে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই সংকট এড়াতে আগে থেকেই পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করে মহাদেশটির দেশগুলো। এবারও তাই করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শীতে গ্যাসের চাহিদা না বেড়ে বরং কমে। এরপরও গ্যাসের সংকটে বাসাবাড়িতে রান্নার চুলা জ্বালানো যায় না দিনের বেলা। শিল্পকারখানাও ধুঁকতে থাকে গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতিতে।
প্রতিবছর শীতে এমনটাই দেখা যায় দেশে। তবে এবারের সংকট অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। প্রশ্ন হলো, শীত এলেই কেন গ্যাসের চাপ কমে?
শীতের সময় তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পাইপলাইনে তরল পদার্থ জমে গ্যাস প্রবাহের চাপ কমে যায়—প্রতিবছর শীতের সময় এমন ব্যাখ্যাই দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে শুধু এই একটি কারণে এত সংকট হওয়ার কথা নয়। বরং সরবরাহ কমার পেছনে এর বাইরে আরও বড় দুটি কারণের কথা বলছেন ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, এবার শীতে গ্যাসের সরবরাহ কমার পেছনে মূল কারণ দুটি। প্রথমটি হচ্ছে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে অনুসন্ধান কমে যাওয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কম আমদানি। এর ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কমেছে। তাই বিদ্যুৎ চাহিদা কমলেও শিল্প আর আবাসিক খাতে গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
শীতের সময় তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পাইপলাইনে তরল পদার্থ জমে গ্যাস প্রবাহের চাপ কমে যায়—প্রতিবছর শীতের সময় এমন ব্যাখ্যাই দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে শুধু এই একটি কারণে এত সংকট হওয়ার কথা নয়। বরং সরবরাহ কমার পেছনে এর বাইরে আরও বড় দুটি কারণের কথা বলছেন ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা।
দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত গ্যাস উৎপাদনের পর তা প্রক্রিয়াজাত করে জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলনের সময় গ্যাসের চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে (পিএসআই) থাকে চার হাজারের মতো। এ চাপের ওপর নির্ভর করে গ্যাসের প্রবাহ। জাতীয় পাইপলাইনে শুরুতে এক হাজার চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে এটির চাপ আরও কমানো হয়। গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদা বুঝে গ্যাসের চাপ বজায় রাখার কাজটি করে গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলো। এতে বড় শিল্পকারখানায় সাধারণত ১৫ থেকে ২০ পিএসআই চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এখন অনেকেই এটি এক থেকে দুই পিএসআই পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন। এমন চাপে গ্যাসের প্রবাহ এলে তা দিয়ে কারখানা সচল রাখা যায় না। আবার আবাসিক খাতে সাধারণত পাঁচ পিএসআই রাখা হয়। এখন দিনের বেলা গ্যাসই পাওয়া যাচ্ছে না রান্নার চুলা জ্বালাতে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির ভূতাত্ত্বিক বিভাগের প্রধান মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শীতে তাপমাত্রা কমে আসায় পাইপলাইনে গ্যাসের সঙ্গে কনডেনসেটের (গ্যাসের একটি উপজাত) মতো তরল পদার্থ চলে আসে। এতে পাইপলাইনের ভেতরে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে গ্যাসের চাপ কমে আসে। এ কারণে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা ব্যাহত হয়। তবে সঠিক চাপে গ্যাসের প্রবাহ ধরে রাখতে তাই নিয়মিত পাইপলাইন পরিষ্কারের কাজটি করে এ খাতের বিভিন্ন সংস্থা।
শীতে পাইপলাইনে কনডেনসেট জমে গ্যাসের চাপ কমার কারণে সংকট হওয়ার কথা নয়। এটা সব সময়ই ছিল। এবারের শীতে গ্যাসের সংকট আগের চেয়ে বেশি হচ্ছে। এটা হচ্ছে মূলত দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমেছে। একই সঙ্গে চাহিদা অনুসারে এলএনজি আমদানি হচ্ছে না। সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।বদরুল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে মোটামুটি সব খাতের চাহিদা পূরণ করা যায়। এমনিতেই সারা বছর এক খাতে কমিয়ে অন্য খাতে বাড়ানোর (রেশনিং) কাজটি করতে হয় গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে। এবার শীতে কোনোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দিনে সরবরাহ হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুটের কম। এতে চাহিদা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরবরাহ কমলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ বেশি সংকটে পড়ে। আগামী মার্চে গ্যাস সরবরাহ বাড়তে পারে।
গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১১০ থেকে ১১২ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০ কোটি ঘনফুট। তবে সার কারখানায় সরবরাহ বেড়েছে। গ্যাসের সংকটের সময় সাধারণত অধিকাংশ সার কারখানা বন্ধ রাখা হয়। বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন দেশে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এখন সার কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ হচ্ছে দিনে ২২ কোটি ঘনফুট।
দেশে আগে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এক বছর ধরে এটি কমছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। শীর্ষ উৎপাদনকারী হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত উৎপাদন কমছে।
গ্যাসের সরবরাহ আসে মূলত দুটি উৎস থেকে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি। বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সাশ্রয়ে ২০২২ সালের জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে সরকার। টানা সাত মাস এটি বন্ধ থাকে। এরপর গত বছরের জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে কেনা শুরু হয় আবার। তবে শিল্প খাতে বাড়ানো হয় ১৭৯ শতাংশ। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের শর্তে এটি মেনে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন আমদানিও হচ্ছে কম। এর ফলে বেশি দাম দিয়েও এখন গ্যাসের অভাবে কারখানা চালানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন তাঁরা।
দেশে আগে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এক বছর ধরে এটি কমছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। শীর্ষ উৎপাদনকারী হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত উৎপাদন কমছে। দিনে ১২০ কোটি ঘনফুটের বেশি সরবরাহ করা হয়েছে একসময়। এখন এখান থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ১০৪ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর এখন নানা কার্যক্রম চলছে। তবে শিগগিরই এ থেকে বড় ধরনের সরবরাহ বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই।
এদিকে আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। দুটি টার্মিনাল মিলে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন একটি টার্মিনালের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। আর মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত ১ নভেম্বর বন্ধ করা হয়। এটি দেড় মাস পর চালুর কথা থাকলেও আড়াই মাস পর গতকাল শুক্রবার রাতে চালু করা হয়। একই দিনে মহেশখালীর চালু থাকা টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি আগামী মার্চে চালু করার কথা রয়েছে।
এ ছাড়া এমনিতেই সারা বছরের পরিকল্পনা অনুসারে শীতের সময় এলএনজি আমদানি কম থাকে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুসারে সারা বছরের আমদানি পরিকল্পনা করা হয়। এ হিসাবে ওমান ও কাতার থেকে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচটি এলএনজি কার্গো আসে। শীতে চাহিদা কম থাকায় গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আনা হয় চারটি করে। এর বাইরে খোলাবাজার থেকে প্রতি মাসে দুটি বা তিনটি এলএনজি কার্গো আনা হয়। এ দুই মাসে আনা হয় একটি করে। আগামী মার্চ থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হতে পারে।
ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, শীতে পাইপলাইনে কনডেনসেট জমে গ্যাসের চাপ কমার কারণে সংকট হওয়ার কথা নয়। এটা সব সময়ই ছিল। এবারের শীতে গ্যাসের সংকট আগের চেয়ে বেশি হচ্ছে। এটা হচ্ছে মূলত দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমেছে। একই সঙ্গে চাহিদা অনুসারে এলএনজি আমদানি হচ্ছে না। সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।