একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা ’৭১ এবং উপধারা একাত্তর, মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ের দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।
মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত সরকারের সহায়তা কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী মন্ত্রিসভাকে সচল ও সক্রিয় করার জন্য পি এন হাকসারকে নিয়োগ করে ইন্দিরা গান্ধী সম্ভবত তাঁর মানবসম্পদের যোগ্যতম ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছিলেন।
এপ্রিল মাসেই শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান স্রোত ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে এমন এক বাস্তবতার মুখে হাজির করেছিল, যে সম্পর্কে শৈথিল্যের কোনো অবকাশ ছিল না। পরিস্থিতি নিয়ে হাকসারের দৃষ্টিভঙ্গি ও গৃহীতব্য উদ্যোগ যথেষ্ট কাছে থেকে দেখার কিছু সুযোগ আমাদের হয়েছে। তাঁর গৃহীতব্য উদ্যোগ নিয়ে ক্রমশ আমাদের আস্থার সঞ্চার ঘটতে থাকে। কিন্তু হাকসারের সঙ্গে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির অমিলও যে ইত্যবসরে বড় হয়ে উঠতে পারে, সেই সংবাদটুকু আমাদের জানা ছিল না।
পি এন হাকসারের সঙ্গে বৈঠকের পরদিন ৭ জুলাই মাকি৴ন প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের প্রথম আলোচনা ছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গে একান্তে—১০ থেকে ১৫ মিনিট। এ সময় আর কেউ সেখানে ছিলেন না। সেই সময়ের মধ্যে কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠি হস্তান্তর করেন।
তিনি বলেন, দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার স্বার্থে যে প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র সরকার চালিয়ে এসেছে—এবং ভারত সরকার যা অনুমোদন করে এসেছে—তারই ধারাবাহিকতায় আরও একটি ধাপ শিগগিরই গ্রহণ করা হবে। এর ফলে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটতে চলেছে, কিন্তু চীন যাতে কোনো অবস্থাতেই ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা হবে।
কিসিঞ্জার জানান, শরণার্থী পরিস্থিতির চাপ যে ভারতের জন্য কত বিশাল, তা কেবল এখানে আসার পরেই তিনি বুঝতে পারছেন। তিনি জানতে চান কত দিন ইন্দিরা গান্ধী এই চাপ ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন? ইন্দিরা জানান, সেই ক্ষমতার শেষ সীমায় তিনি ইতিমধ্যেই পৌঁছেছেন।
কেবল কঠোর সংকল্প দিয়ে এ অবস্থা তিনি টিকিয়ে রেখেছেন এবং দুজন মানুষকেও এখানে একমত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাঁরা তাঁর নীতি সমর্থন করেন। তবে তিনি এটাও বলেন, এই জনমত প্রতিষ্ঠিত একধরনের আবেগের ওপর, উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি, স্থানীয় মানুষের আয়-উপার্জন ভীষণভাবে হ্রাস পাওয়া, দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
কাজেই উদ্বাস্তুর সংখ্যা যদি দ্রুত হ্রাস পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তবে চরম পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে মানুষের চাপ কমবে। সে রকম কোনো সমাধানে ভারতের নিজের কোনো দাবি নেই; নির্দিষ্ট কোনো মত নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যা করবেন, তা–ই ভারত সরকার গ্রহণ করবে। ‘...ইন্দিরা বলেন, যুদ্ধের পথ তিনি পরিহার করতে চান।’
বস্তুত এর আগে, ২৮ মে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক লিখিত চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন, ‘আমরা প্রধান–গোপন কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হতে চাই, যা ইতিমধ্যে আপনাদের রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমরা অবহিত করেছি। আমরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ পথে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য গুরুত্বসহকারে আলোচনাও করেছি, যাতে উদ্বাস্তুর স্রোত থেমে যায় এবং যারা এসেছে তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়।’ (সূত্র: কিসিঞ্জার: হোয়াইট হাউস ইয়ার্স, পৃ. ৮৫৭)।
এরপর ২৮ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর বেতারভাষণে শরণার্থীদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানান বটে, কিন্তু তাঁর আমলারাই একতরফাভাবে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে মার্শাল ল বহাল থাকবে, এমন ঘোষণা করে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ বন্ধ করে রাখেন।
তা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সেই পুরোনো আশ্বাসকে অবলম্বন করেই কিসিঞ্জারের কাছে শান্তিপূর্ণ পথে সংকটমোচনের জন্য নিক্সনের উদ্যোগ প্রত্যাশা করেন। এর উত্তরে কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া যদি কোনো সমাধান বের করা যায়, তবে তা কি গ্রহণযোগ্য হবে?
একান্ত আলোচনার সময় যেখানে সীমিত, সেই সময়টুকুর মধে৵ কোনো অহেতুক জল্পনা–কল্পনার সুযোগ ছিল না, যদি না কিসিঞ্জারের মনে নির্দিষ্ট কোনো সমাধানের প্রস্তাব না থাকত। একান্ত বৈঠকের সময়সীমা তখনই শেষ হওয়ায় আলোচনায় যোগদানের জন্য পি এন হাকসার, দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং সংশ্লিষ্ট সহকারী সেখানে হাজির হন।
ইন্দিরা বিস্তারিত কিছু জিজ্ঞাসা না করে বলেন, সমাধান গ্রহণ করার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয়। এ সম্পর্কে ভারতের কোনো অভিমত নেই। ভারত বিষয়টির সঙ্গে জড়িত শুধু শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নিয়ে।
ওই দিন কিছু পরে কিসিঞ্জার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। তখন সরদার শরণ সিং একই কথা পুনরুক্তি করে বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়াই পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের প্রতিনিধিরা যদি কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারেন, তবে ভারতের তাতে কোনো আপত্তি নেই। অবশ৵ শরণ সিং স্পষ্ট ভাষায় কিসিঞ্জারকে জানিয়ে দেন যে ২৮ জুন ইয়াহিয়ার বেতারভাষণ আপস–মীমাংসার পথ আরও দুরূহ করে ফেলেছে।
আরেকটি বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জগজীবন রাম সীমান্তে চীনের আক্রমণ আশঙ্কা উল্লেখ করার পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিসিঞ্জার তাঁকে আশস্ত করেন চীন যদি বিনা প্ররোচনায় তেমন আক্রমণ চালায়, তবে তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবে।
কিসিঞ্জার দিল্লি থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে তাঁর প্রথম ২৪ ঘণ্টার আলোচনা সম্পর্কে জানান, ‘এখানে অধিকাংশ আলোচনাকারী এখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক মীমাংসার প্রচেষ্টার কথা বলে চলেছেন। কিন্তু মনে হয় তাঁদের অধিকাংশই ক্রমশ এই ধারণার দিকে যাচ্ছেন যে ইয়াহিয়ার তেমন শক্তি হয়তো নেই, অন্তত বর্তমান যাত্রায় তা ঘটে উঠবে না।
মনে হয়, যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে, অথবা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এগুলো কেউ যে চাইছে, তা নয়, কিন্তু কেউ জানে না তেমন পরিণতি কীভাবে এড়ানো যাবে।’
ইন্দিরা গান্দীর সঙ্গে আলোচনা বিষয়ে কিসিঞ্জার ওই প্রতিবেদন বলেন, ‘তিনি (ইন্দিরা) তাঁর রাজনৈতিক সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করেন, তিনি জানান যে সামরিক শক্তি প্রয়োগে অনিচ্ছুক এবং এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ গ্রহণে আগ্রহী।
তবে তিনি পর্যবেক্ষণ করবেন পরিস্থিতি কীভাবে বিকশিত হয় এবং বাস্তব উদ্যোগ কী নেওয়া যায়।...আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলি আমাদের পলিসির মূল লক্ষ্য হলো কীভাবে আমাদের প্রভাব সংহত করে তোলা যায়, যার ফলে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর কাজে সেই প্রভাব প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, যদিও এ ব্যাপারে আমরা কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে অপরাগ।’ (সূত্র: FRUS, ভলিউম ১১, দলিল ৯৪)।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই দলিল অবমুক্ত হয়েছিল ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে। তাতে আবারও জানা যায়, কিসিঞ্জার তাঁর দিল্লি সফর শেষ করেছিলেন কোনো বড় বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে, যুদ্ধ পরিহার করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে এবং শরণার্থী ফেরত পাঠানোর পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি না দিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতার দাবি পরিহার করেও প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের যে ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ অবমুক্ত দলিলে নেই।
১৯৭৩ সালের জুন মাসে শুরু করা ‘কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের’ সহায়তায় পরিচালিত এক অনুসন্ধানে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ ‘সন্দেহাহীতভাবে’ প্রমাণ পান যে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার একাংশের সহায়তায় স্বাধীনতাসংগ্রামকে দ্বিধাবিভক্ত করে পাকিস্তান অটুট রাখার পক্ষে উভয় অংশের নেতাদের মধ্যে আপস–আলোচনার কথা প্রথম বিবেচনা করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের জুন মাসে। অর্থাৎ কিসিঞ্জারের ভারত সফরের আগের মাসে।
কিসিঞ্জার আত্মজীবনীমূলক হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে (পৃ.৮৬২) উল্লেখ করেছেন, জুলাই মাসে ভারত, পাকিস্তান ও চীন সফরের পর সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাঁর মনে হয়েছিল, বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর শরণার্থী সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে।
কিসিঞ্জার বলেছেন, ভারতকে এ ব্যাপারে নিবৃত্ত রাখার কোনো ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না; শরণার্থীর স্রোত বন্ধ করারও প্রভাব তাদের নেই। অথচ চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের এই নাজুক পর্বে বাংলাদেশকে কেন্দ্র এই যুদ্ধ বন্ধ রাখা ছিল অত্যন্ত জরুরি। এমন বাধ্যবাধকতার আবর্তে বাংলাদেশের জন্য অন৵ এক অন্তর্ঘাতমূলক কর্মতৎপরতা শুরু হয়।
৩১ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতিনিধি দাবি করে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী এমএনএ কলকাতায় অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেটে উপস্থিত হন।
এক বিস্ময়কর দ্রুততায় তিনি কলকাতা কনস্যুলেট থেকে শুরু করে হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সবার মধ্যে এমন বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হন যে বাংলাদেশের চরমপন্থী তথা কমিউনিস্টদের প্রভাব চলমান মুক্তিযুদ্ধের কারণে দ্রুত প্রসার লাভ করে চলেছে, যা প্রতিরোধের জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ‘মার্কিনপন্থী ও ভারতপন্থী’ নেতৃত্ব সবাই সংকল্পবদ্ধ এবং তাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে আপস-মীমাংসা শুরু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তা চান।
এ কার্যক্রমের সূত্র ধরেই পরবর্তী তিন মাস ধরে চলে স্বাধীনতাসংগ্রামের বিভিন্ন সাংগঠনিক স্তর, বিশেষত মন্ত্রিসভাকে বিভক্ত করে ফেলার কার্যকলাপ।
মাত্র দেড় মাসের মধ্যে অর্থাৎ আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে এই অন্তর্ঘাতমূলক চক্রান্ত পরিস্থিতিকে এমন জায়গায় দাঁড় করায়, যখন গোটা মন্ত্রিসভা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য বাদ দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সঙ্গে আপস–মীমাংসা করার পক্ষে সহায়তা করার জন৵ যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
কিসিঞ্জার দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর মন্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্নমুখী সম্ভাবনার আলোচনার পর ৮ জুলাই পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ যান। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপমহাদেশে সামরিক সংঘাতের কারণ দূর করার কৌশল অন্বেষণই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য।
কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তাঁর পরামর্শদাতাদের বলেন, ভারত যে যুদ্ধ শুরু করবে না, এমন নিশ্চয়তা তিনি দিল্লিতে খুঁজে পাননি, কারণ যে ব্যাপকভাবে শরণার্থীরা ভারতে প্রবেশ করছে, তা কমানো না গেলে জনমতের চাপে ভারতকে যুদ্ধে নামতে হবে।
এই শরণার্থীর চাপ কমানোর জন্য ছোটখাটো উদ্যোগ পাকিস্তান ইতিমধ্যে গ্রহণ করার সম্মতি জানিয়েছে। যেমন ভারত থেকে শরণার্থী ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা, এ জন্য জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগে সম্মত হওয়া, মিলিটারি গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে বশংবদ বাঙালি ডাক্তার আবদুল মালেককে নিয়োগ করা প্রভৃতি। এসব পদক্ষেপ একসঙ্গে গ্রহণ করা, যাতে এগুলোর মিলিত প্রভাবে শরণার্থীর স্রোত কমতে শুরু করে।
অনুমান করা হয়, শরণার্থীর চাপ কমতে শুরু করলে ভারতের জনমত কিছুটা সহনীয় হবে। এতে ভারতের সামরিক শক্তি প্রয়োগের বাধ্যবাধ্যকতা কমতে পারে, এমনি দুর্বল প্রত্যাশা অবলম্বন করেই চলে এসব পরামর্শ।
বস্তুত ২৮ জুন ইয়াহিয়ার বক্তৃতায় রাজনৈতিক সমঝোতার সমস্ত সম্ভাবনা নাকচ করার পর পূর্ব পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সদ্য সূচিত তৎপরতা অধিকতর কঠোরতার সঙ্গে দমন করার জন্য নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের মাত্রা পূর্বাপেক্ষা বাড়িয়ে তুলে সর্বাধিক সংখ্যায় রাজাকার ট্রেনিং ও নিয়োগ করে। শুধু তা–ই নয়, আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থার ওপরও পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনী আক্রমণ শুরু করে।
নিয়াজি এসব কাজের পরিধি বাড়ানোর জন্য পূব৴ পাকিস্তানে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্তত আরেক স্কোয়াড্রন জঙ্গি বিমান সরবরাহের জন৵ চাপ বৃদ্ধি করেন। ভারতে অবস্থিত মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প আক্রমণের পুরোনো লক্ষ্যটি চীনের সাহায৵ সাপেক্ষে তখনো বিবেচনাধীন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের শক্তিমত্তা বাড়বে, এমন বিশ্বাস পাকিস্তান শাসকদের মধ্যে ছিল আগের মতোই প্রবল।
তা ছাড়া জুলাই-আগস্ট সময়টি ছিল বর্ষাকাল, যখন অসংখ্য নদী এবং খাল-বিল ভরা পূর্ব বাংলা ছিল ভারতের সামরিক প্রত্যাঘাতের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী। অধিকন্তু পাকিস্তানের প্রত্যাশা ছিল ভারত সীমান্তের সব গিরিপথ বরফমুক্ত থাকায় ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলী চাপ সৃষ্টি করা চীনের জন৵ অসুবিধার হতো না।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের অভিমত ছিল, শরৎকালীন যুদ্ধে বিপর্যয়ের ঝুঁকি নগণ্য বিধায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতাকে এক বৃহত্তর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে নিয়োজিত করা, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিশ্চিত করার হিসাব-নিকাশ তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কাজেই কিসিঞ্জারের পরামর্শ ভারতের জন্য যে ততটা গ্রহণযোগ্য নয়, তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন।