জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। নারীর চিকিৎসার প্রতি উদাসীনতা ও অসচেতনতায় প্রতিরোধযোগ্য এটি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
মমতাজের বিয়ে হয়েছিল ১৭ বছর বয়সে। ১৮ বছর বয়সে মা হন। তৃতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার আগপর্যন্ত তাঁর তিনবার গর্ভপাত হয়। তলপেটে ব্যথা অনুভব, রক্তপাতের মতো সমস্যা নিয়ে ‘ভায়া’ পরীক্ষার পর ২০১৯ সালে তাঁর জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্ত হয়।
ভায়া হচ্ছে ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন অব দ্য সারভিক্স উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড পরীক্ষা, যার মাধ্যমে নারীর জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা আগেই জানা যায়।
৩৫ বছর বয়সী মমতাজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গত রোববার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে। রাজধানীর মিরপুর–১৩ নম্বর থেকে সেদিন তিনি এসেছিলেন ফলোআপ চিকিৎসায়। বিষণ্ন কণ্ঠে মমতাজ বললেন, চিকিৎসকের কাছ থেকে শুনে এখন তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর বাল্যবিবাহ, ঘন ঘন গর্ভধারণ, জন্মনিরোধক বড়ি সেবনের কারণে জরায়ু পরীক্ষায় সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় সঙ্গে থাকা তাঁর স্বামী বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বলে বসলেন, ‘এত কথা (অভিযোগ) তো আগে শুনিনি!’
শুরুতে সচেতন না হওয়ায় নিজের ‘কপাল’কে দায়ী করেন পোশাক কারখানার কর্মী
শাহেরা (৫০)। রাজধানীর মিরপুর–১–এর বাসিন্দা একলা নারী শাহেরাও বহির্বিভাগে ফলোআপ চিকিৎসায় এসেছিলেন। তিনি বলেন, বছর তিনেক আগে ক্যানসার শনাক্ত হওয়ায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর জরায়ু অপসারণ করা হয়। এর আগে তিনি এ ক্যানসারের নামও শোনেননি। এখন মাসে সাড়ে ৯ হাজার টাকা বেতনের এক–তৃতীয়াংশ তাঁর চলে যায় ওষুধ কিনতে।
হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, ১৪ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে ২০ নারী এসেছিলেন জরায়ুমুখ ক্যানসার নিয়ে। দিনে গড়ে প্রজননতন্ত্রের ক্যানসার নিয়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৩০ শতাংশ আসেন জরায়ুমুখ ক্যানসার নিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সবশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন এবং বছরে মারা যান ৪ হাজার ৯৭১ জন।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের মতে, জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। নারীর চিকিৎসার প্রতি উদাসীনতা ও অসচেতনতার কারণে প্রতিরোধযোগ্য জরায়ুমুখ ক্যানসার বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাই নারীর বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর হলেই নিয়মিত স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা করার ওপর জোর দিয়ে এবার ১৯ থেকে ২৫ জানুয়ারি পালন করা হচ্ছে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ সপ্তাহ। বৈশ্বিকভাবে জানুয়ারি মাসকে ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। ‘মার্চ ফর মাদার’ নামে দেশের একটি বেসরকারি জোট ২০১৮ সাল থেকে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় শনিবারকে জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সবশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন এবং বছরে মারা যান ৪ হাজার ৯৭১ জন।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান (নিপসম) ২০২০ সালে ‘ন্যাশনাল স্টেপস সার্ভে ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ রিস্ক ফ্যাক্টরস ইন বাংলাদেশ ২০১৮’ শিরোনামের প্রতিবেদনে অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্ত কি না, তা জানতে জীবনে একবার পরীক্ষা করেছেন ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সী ৪ শতাংশের কিছু বেশি নারী।
কিশোরীদের টিকা দিলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ হতে পারে। তবে সম্পূর্ণ ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরীদের ৩০ বছরের বেশি বয়স হলে অবশ্যই ভায়া পরীক্ষা করা উচিত।অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা, পরিচালক, ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিং উইথ পপুলেশন বেইজড সারভাইক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও বর্তমানে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার জানান, একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যানসার আক্রান্তের ঝুঁকিতে আছে কি না, তা ভায়া পরীক্ষায় অন্তত ৩ বছর আগে এবং সর্বাধুনিক এইচপিভি/ডিএনএ পরীক্ষায় ১০ বছর আগে জানা সম্ভব। তাঁর মতে, জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে পরিবারের পুরুষেরও দায়িত্ব রয়েছে, বাড়ির কিশোরীকে টিকা দেওয়া ও নারী সদস্যকে এ পরীক্ষাগুলো করানোর উদ্যোগ নেওয়া। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ রোধসহ বাড়ির কিশোরী ও নারীরা যেন মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া।
‘সময় শেষ করে আসেন তাঁরা’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প বয়সে বিয়ে, বেশি সন্তান, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, অপুষ্ট দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া, একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন মিলনে সম্পৃক্ত স্বামীদের কারণেও জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষ্মণের মধ্যে রয়েছে, ঘন সাদা স্রাব, অতিরিক্ত রক্তস্রাব ও অনিয়মিত রক্তস্রাব।
জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায়, ৭০ শতাংশ নারীকে ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে অন্তত দুবার স্ক্রিনিং এবং ক্যানসারের পূর্ব–অবস্থা বা ক্যানসার শনাক্ত হওয়া ৯০ শতাংশ নারীকে চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প বয়সে বিয়ে, বেশি সন্তান, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, অপুষ্ট দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া, একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন মিলনে সম্পৃক্ত স্বামীদের কারণেও জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষ্মণের মধ্যে রয়েছে, ঘন সাদা স্রাব, অতিরিক্ত রক্তস্রাব ও অনিয়মিত রক্তস্রাব।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বেগম রোকেয়া আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতালে বছরে গড়ে দেড় হাজার নারী আসেন জরায়ুমুখ ক্যানসার নিয়ে। এর মধ্যে ১০০ জনের অস্ত্রোপচারের মতো অবস্থা থাকে। বাকিদের অবস্থা এত খারাপ থাকে যে রেডিওথেরাপিতে চলে যেতে হয়। এরপরও অনেককে চিকিৎসার কথা বললে বলেন, ‘বাড়ি থেকে বুঝে আসি’। অনেকে আর চিকিৎসা নেন না, বাড়ির লোকজন বোঝান ‘সেঁক’ (রেডিওথেরাপি) দিলে মরতে হবে।
গত বছরের ২ অক্টোবর থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে সরকার বিনা মূল্যে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু করেছে। সারা দেশে এক কোটির বেশি কিশোরীকে এই টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মাত্র ২০ শতাংশ নারীকে ভায়া পরীক্ষার আওতায় আনা গেছে। এই কেন্দ্রের অধীন রয়েছে ‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিং উইথ পপুলেশন বেইজড সারভাইক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি’ প্রকল্প। এর পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা প্রথম আলোকে বলেন, কিশোরীদের টিকা দিলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ হতে পারে। তবে সম্পূর্ণ ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরীদের ৩০ বছরের বেশি বয়স হলে অবশ্যই ভায়া পরীক্ষা করা উচিত।
সরকারি হাসপাতালে ভায়া পরীক্ষা বিনা মূল্যে করা যায়। উন্নত দেশগুলোয় এখন আধুনিক এইচপিভি/ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। দেশে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এই পরীক্ষা করতে আড়াই হাজার টাকা লাগে। বেসরকারি হাসপাতালে লাগে এর আড়াই গুণ বেশি। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আড়াই হাজারের কম টাকায় এইচপিভি/ডিএনএ পরীক্ষা করার সুযোগ চালু হতে যাচ্ছে।