সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য: কোনটি ঠিক কোনটি ভুল

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো প্রতিবছরের মতো এবারও তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই মাসে দেওয়া এসব প্রতিবেদনে ২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। তিন বেসরকারি সংগঠনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে দুর্ঘটনা ও নিহত মানুষের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে তিন সংগঠনের দেওয়া আহত মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান। ১২ হাজারের ঘরে।

সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সরকারিভাবে সংগ্রহ করে পুলিশ। এসব তথ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআরটিএ) বিভিন্ন সংস্থা ব্যবহার করে। পুলিশের দেওয়া তথ্যেও দুর্ঘটনার যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যার ক্ষেত্রে বেসরকারি সংগঠনগুলোর সঙ্গে পুলিশের দেওয়া উপাত্তের বেশ অমিল দেখা যায়।

সড়ক দুর্ঘটনা ও এর সংখ্যা নিয়ে সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনের দেওয়া উপাত্তের এই অমিল প্রতিবছরই দেখা যায়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে।

গত রোববার রাজধানীতে বিআরটিএ আয়োজিত এক সভায় বেসরকারি সংগঠনগুলোর সংখ্যা নিয়ে প্রবল আপত্তি তোলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পুলিশের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দুর্ঘটনার সংখ্যা কমছে; কিন্তু বেসরকারি সংগঠনগুলো মনগড়া তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছে।

তবে দুর্ঘটনাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, দুর্ঘটনা নিয়ে পুলিশের তথ্য অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত। দুর্ঘটনার পর কেবল মামলার নিরিখেই পুলিশ দুর্ঘটনা ও এতে হতাহতের সংখ্যা নথিবদ্ধ করে। অনেক কিছুই তাতে বাদ পড়ে যায়। যেমন দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘটা দুর্ঘটনা, আহত হয়ে পরে মারা যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা—এসব পুলিশের হিসাবেই থাকে না।

শুধু সরকারের দেওয়া দুর্ঘটনার তথ্যের ক্ষেত্রেই যে অপর্যাপ্ততা আছে, বিষয়টি তা নয়। বেসরকারি সংগঠনগুলো যেসব তথ্য-উপাত্ত দেয়, সেগুলোর মধ্যেও একটির সঙ্গে অন্যটির ভিন্নতা থাকে। বেসরকারি সংগঠনগুলোর দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্যের উৎস গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন। সেখানে পুনরাবৃত্তির ঘটনা ঘটে বলেও অনেকে মনে করেন।

সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই দুর্ঘটনা নিয়ে হাসপাতালের তথ্য এবং বিমাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ এবং তা যাচাই-বাছাই করে না। অর্থাৎ দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সব উৎসেরই সীমাবদ্ধতা আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্ঘটনা নিয়ে সমন্বিত, বহুমাত্রিক, গ্রহণযোগ্য তথ্যব্যাংক থাকা দরকার। এটি তৈরি করতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। পারস্পরিক দোষারোপ করে হয়তো আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে আখেরে লাভ হবে না।

বিআরটিএর দাবি, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে থানা পর্যায় থেকে দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্য তারা কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করে থাকে। এটি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে অবশ্যই মামলা বা জিডি হয়। কাজেই পুলিশের দুর্ঘটনার মৃত্যুর সংখ্যায় কোনো ভুল হওয়ার সুযোগ নেই।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটো ছেলে কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় মারামারি করলে পুলিশ তা জানতে পারে। তাহলে দুর্ঘটনার মতো বড় বিষয় তারা জানতে পারবে না কেন।’

তবে বিশেষজ্ঞদের কথা, যেসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হয়, পুলিশ শুধু সেগুলোরই হিসাব রাখে। সব দুর্ঘটনা বা দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের ক্ষেত্রে মামলা হয় না। তার মানে, অনেক ঘটনা ঘটলেও মামলা না হওয়ায় সেই সংখ্যা আর যুক্ত হচ্ছে না।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘মামলা হলে শুধু ওই দুর্ঘটনা এবং তাৎক্ষণিকভাবে যাঁরা মারা গেলেন বা আহত হলেন, তাঁদের নাম নথিবদ্ধ হয় পুলিশের খাতায়। কিন্তু হাসপাতালে যাঁরা মারা গেলেন বা দুর্ঘটনাজনিত আঘাতে তিন মাস পর যাঁরা মারা গেলেন, তাঁদের নাম পুলিশের কাছে আসে না। তাই দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের যে সংখ্যা পুলিশের প্রতিবেদনে আসছে, সেটা পর্যাপ্ত নয়, সেটি অসম্পূর্ণ।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলছেন, বেসরকারি সংগঠনগুলো দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে গণমাধ্যম থেকে। এটি আসলে সেকেন্ডারি উৎস। পক্ষান্তরে পুলিশ দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর মামলা করে এবং দুর্ঘটনাস্থলে নিহত বা পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের তথ্য নথিভুক্ত করে। কিন্তু যাঁরা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েক দিন পর মারা যান, তাঁদের হিসাব পুলিশ সম্ভবত নথিভুক্ত করে না।

সরকারের তরফে বেসরকারি সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় বরাবরই। সে ক্ষেত্রে একই সংখ্যা একাধিকবার গণনা করে ফেলা হয় বলে তাদের অভিযোগ।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘এক সংগঠনের তথ্যের সঙ্গে আরেক সংগঠনের তথ্যের মিল নেই। তাদের দেওয়া উপাত্ত যথার্থ হলে এমনটা তো হওয়ার কথা না। এসব তথ্য সংগঠনের জন্য যে পরিকাঠামো দরকার, তা-ও তো এসব সংগঠনের নেই।’

বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা অবশ্য দাবি করেন, তাঁরা গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করেই উপাত্ত তুলে ধরেন। তবে কিছু সংগঠন যে আগ বাড়িয়ে অতিরঞ্জন করে, সেটা স্বীকার করেন সাইদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু সংগঠন তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতির দিকে মনোযোগী না হয়ে তথ্য প্রকাশে বেশি মনোযোগী হয়। যার ফলে তথ্য-উপাত্তে ব্যাপক গরমিল হয়। এটা একধরনের অনৈতিক কাজ।

তবে আমরা গণমাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করি। কোনোভাবে যেন একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখি। ফলে পুলিশের হিসাবের চেয়ে আমাদের হিসাব কিছুটা বেশি হয় বটে, তবে ব্যাপক পার্থক্য হয় না।’

কিছু ক্ষেত্রে এমন ভুল হলেও বেসরকারি সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন অধ্যাপক মোয়াজ্জেম। তাঁর বক্তব্য, ‘বেসরকারি সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বাস্তবতার অনেকটাই কাছাকাছি। এসব সংগঠন পত্রিকা বা অন্যান্য গণমাধ্যম দেখে রেকর্ডগুলো করে। আমাদের গণমাধ্যমের যে পরিসর, তা কিন্তু যথেষ্টই বিস্তৃত। জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমকে যদি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে মোটামুটি একটি সঠিক চিত্র পাওয়া যায়। তবে এরপরও বলা যায়, এসব সংগঠনের প্রতিবেদনও একেবারে যথার্থ নয়।’

কেন যথার্থ নয়, তা-ও বলেন অধ্যাপক মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘পুলিশের তথ্য, হাসপাতালের তথ্য এবং বিমা কোম্পানির তথ্য সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার সমন্বিত তথ্যভান্ডার থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে এ চর্চা নেই। হাসপাতাল ও বিমা কোম্পানির প্রতিবেদনও বেসরকারি সংগঠনগুলো করে না। তারা যত দুর্ঘটনার খবর আসে, সেগুলো প্রায় শতভাগ তুলে ধরে। এভাবে যদি পুলিশের দেওয়া উপাত্তের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর উপাত্তের তুলনা করি, সেখানে প্রায় ৪০ শতাংশের হেরফের হয়।’

এভাবে যাতে সংখ্যার ‘হেরফের’ না হয়, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য, যথার্থ তথ্যভান্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন অনেকেই। কারণ, এর সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নও জড়িত বলে মনে করেন গবেষক ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘নতুন ধারার মহামারি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে সংখ্যার বিতর্কের মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর অ্যাজেন্ডা যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্য সাবধান করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।

হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘মহামারির বাস্তবতা সরকারকে স্বীকার করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্ব আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তো প্রতিপক্ষ নয়। সরকার আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের মালিক সবাই। এ বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে।’