চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডোর হামলায় বিধ্বস্ত পাকিস্তানি জাহাজ
চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডোর হামলায় বিধ্বস্ত পাকিস্তানি জাহাজ

অপারেশন জ্যাকপট পাল্টে দিয়েছিল যুদ্ধের গতি

রাতের আঁধারে ডুবসাঁতার দিতে দিতে একেবারে লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছানো। স্থির কোনো জলাশয় নয়, একেবারে উত্তাল কর্ণফুলীতে। এরপর মাইন বেঁধে দেওয়া জাহাজের গায়ে। অতঃপর আধা ঘণ্টার মধ্যে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া। শেষে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। কল্পনা নয়, ১৯৭১ সালে সত্যি এ রকম নিখুঁত অভিযান চালিয়েছিলেন বাংলার নৌ মুক্তিসেনারা।

এই অপারেশনের নাম ছিল অপারেশন জ্যাকপট। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন সফল অভিযান সাড়া ফেলে দিয়েছিল পুরো বিশ্বে। মুক্তিকামী বাঙালির দাবির প্রতি বিশ্ববাসীও সজাগ হয়ে ওঠে। শত্রুপক্ষ পাকিস্তানের মনোবলে দারুণ আঘাত করেছিল অপারেশন জ্যাকপট। শুধু চট্টগ্রাম নয়, ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে দেশের আরও তিন স্থানে একই নামে নৌ কমান্ড অভিযান চলে। বাকিগুলো হলো মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জের নদীবন্দরে অভিযান।

সফলতার অন্যতম কারণ হলো অভিযানে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অস্ত্র, খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এবং এই গেরিলা অভিযানে অংশগ্রহণকারী অসমসাহসী কোনো মুক্তিযোদ্ধা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়েননি। তাই যুদ্ধ চলাকালীন বাঙালির শৌর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল অপারেশন জ্যাকপট। এখনো সেই কীর্তিগাথার সাক্ষী কর্ণফুলীপারের চট্টগ্রাম।

পরিকল্পিত এ অভিযানের ভিত রচিত হয়েছিল আরও আগে। এর পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল যুদ্ধ শুরুর দুই মাসের মাথায় ’৭১-এর মে মাসে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। পরে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরের অভিযান তাঁর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। চট্টগ্রামের ওই অভিযানের কমান্ডার ছিলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।

চট্টগ্রাম বন্দরের অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। এই কৃতিত্ব তাঁকে বীর প্রতীক খেতাব এনে দিয়েছিল। ফারুক ই আজম পরে ১৯৭১ যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা শীর্ষক একটা বই লেখেন। অভিযানটি ছিল আত্মঘাতী। এ জন্য প্রত্যেক যোদ্ধার ছবি এবং একটা কাগজে স্বাক্ষরও নিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে সফল এই অভিযানে কারও প্রাণ সংহার হয়নি। 

মুক্তিযোদ্ধাদের এমন সফল অভিযান সাড়া ফেলে দিয়েছিল পুরো বিশ্বে। মুক্তিকামী বাঙালির দাবির প্রতি বিশ্ববাসীও সজাগ হয়ে ওঠে। শত্রুপক্ষ পাকিস্তানের মনোবলে দারুণ আঘাত করেছিল অপারেশন জ্যাকপট। শুধু চট্টগ্রাম নয়, ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে দেশের আরও তিন স্থানে একই নামে নৌ কমান্ডো অভিযান চলে।

মেজর রফিকুল ইসলাম অপারেশন জ্যাকপটের স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইয়ে। এই অপারেশনের আগে ১৯৭১ সালের ২৩ মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় ভাগীরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে একটি গোপন প্রশিক্ষক ক্যাম্প খোলা হয়। এটি সি-টু-পি ক্যাম্প নামে পরিচিত ছিল। জুনের প্রথম দিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা স্বাস্থ্যবান ও ভালো সাঁতার জানেন, এমন ৩০০ জনের একটি দল ‘সি-টু-পি’ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে।

প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে দীর্ঘ সময় ঢেউ ও স্রোতের মধ্যে নদীতে অবস্থান করা যায় এবং সাঁতার কাটতে পারার দক্ষতা অর্জন করা যায়। শরীরে লিমপেট মাইন বেঁধে পানিতে চলাচলের বিষয়টিও প্রশিক্ষণে প্রাধান্য পায়।

প্রশিক্ষণ পর্যায়ের শেষে অপারেশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে ফারুক ই আজম তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক ও ভারতীয় উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং উপস্থিত থেকে সবকিছু তদারক করলেন। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র বণ্টন করলেন।’

অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে অভিযান হয় উল্লেখ করে মেজর রফিকুল ইসলাম লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইয়ে লিখেছেন, দলের কমান্ডারদের জানানো হয়েছিল, রেডিওতে আকাশবাণী কলকাতা স্টেশন থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে দুটি বাংলা গানকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গান দুটির প্রথমটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’ ও দ্বিতীয় গান ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’।

প্রথম গানের অর্থ ছিল, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে। আর দ্বিতীয়টির সংকেত হলো আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ করতে হবে।

২৮ জুলাই ‘ডেলটা’ সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ১৫ আগস্টের পর মধ্যরাতে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরে ‘এমভি হরমুজ’ এবং ‘এমভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি জাহাজ নোঙর করা ছিল। এগুলোতে প্রায় ২০ হাজার টন সমরাস্ত্র ছিল বলে বইয়ে উল্লেখ রয়েছে। চট্টগ্রামের জন্য প্রাথমিকভাবে ৬০ জন নৌ কমান্ড প্রস্তুত করা হয়েছিল। সরাসরি অংশ নেন ৩১ জন। প্রতিজন নৌ কমান্ডোকে একটি করে ‘লিমপেট মাইন’, একটি ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাঁদের কয়েকজনের কাছে একটি করে স্টেনগান ছিল। নেতা আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর জন্য ছিল একটি রেডিও।

ফারুক ই আজম তাঁর বইয়ে লেখেন, ‘আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী আমাদের উদ্দেশে বললেন, রাতেই বন্দরে অভিযান করতে হবে। দ্বিতীয় গানটি আজ সকালে আকাশবাণীর খবরের পর বাজানো হয়েছে “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি”। এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত আক্রমণের সংকেত অর্থাৎ রাতেই অভিযান সম্পন্ন করতে হবে। তাই আমাদের একটি রেডিওটি দিয়েছিল।

আক্রমণের প্রস্তুতিকালে নৌ–কমাণ্ডোরা। সবার বুকে মাইন বাঁধা ছিল

 ফারুক ই আজম লিখেছেন, ‘রাত ১১টায় সবাই নদীর পাড়ে উপস্থিত হলাম। পরনের কাপড় খুলে সংগঠকের হাতে দিলাম। এখন আমাদের পরনে সাঁতারের জাঙিয়া, তাতে গোঁজা কমান্ডো ড্যাগার, পায়ে ফিন্স (একধরনের সাঁতারের জুতা), হাতে একটি লিমপেট মাইন ও গামছা। নদীর ওপাড়ের জেটি, জাহাজ এবং নদীর মধ্যে নোঙর করা জাহাজের আলোয় আমাদের আবছা দেখা যাচ্ছিল। তারই মধ্যে প্রতি জাহাজের জন্য তিনজন কমান্ডোকে টার্গেট দেওয়া হলো। একইভাবে জেটি পন্টুন এবং ভাসমান বার্জকেও ডোবাতে হবে। যদি পাকিস্তানিরা গানবোট নিয়ে সক্রিয় হয়, তবে কূলে হাবিলদার সামশু রকেট লঞ্চার থেকে গোলাবর্ষণ করে আমাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’

স্রোতস্বিনী কর্ণফুলীর বুকে নেমে পড়লেন যোদ্ধারা। তখন নদীতে জোয়ার-ভাটার মাঝামাঝি অবস্থা। পানি অনেকটা স্থির। গামছা দিয়ে লিমপেট মাইনটি বুকের ওপর বেঁধে নৌ কমান্ডোর চিত হয়ে সাঁতারে নিঃশব্দে জেটিতে পৌঁছায়। জেটিতে কোনো পাহারাদার ছিল না।

ফারুক ই আজম উল্লেখ করেন, ‘ডুব দিয়ে জাহাজের নিচের দিকে মাইন লাগানোর নির্দেশ ও প্রশিক্ষণ ছিল। কিন্তু এই সময় ভয়জনিত অতি উত্তেজনায় অতিদ্রুত শ্বাস নিতে হচ্ছিল বিধায় ডুব দেওয়া সম্ভব হলো না। গামছা খুলে মাইনটি হাতের নাগালের মধ্যে বার্জের গায়ে দ্রুত লাগিয়ে দিলাম। মাইনের তলায় লাগানো শক্তিশালী চুম্বক জাহাজে আটকে গেল। এবার দ্রুত প্লাস্টিকের নিরাপত্তা ক্যাপটি খুলে নিলাম। বিস্ফোরণের প্রক্রিয়া শুরু হলো। এখন পালানোর জন্য মাত্র আধঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। যত দ্রুত সম্ভব নিঃশব্দে সাঁতরে ওপারে ফিরে চললাম। নির্ধারিত জায়গায় সংগঠকদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে চৌধুরী সাহেব অভিযান পরিচালনা করছিলেন। তার কাছে ফিরে পানি থেকে ওঠার সময় পায়ের ফিন্স জোড়া নদীতে ফেলে দিলাম।’

এরপর কমান্ডোরা একে একে তীরে উঠে সবাই পালাতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে তাদের কানে আসছিল বিস্ফোরণের শব্দ। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম বন্দর ও আশপাশ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে অভিযানে অংশগ্রহণকারী দলটিতে ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শাহ আলম। অপারেশন শেষ করে পালানোর সময় নৌ কমান্ডো হাবিলদার সামশুর পায়ে খেজুরকাঁটা বেঁধে। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন যোদ্ধারা, সেখানে পরদিন একটা ব্লেড আগুনে গরম করে সামশুর পায়ের কাঁটা বের করে এনেছিলেন শাহ আলম। পরে এই শাহ আলম বীর উত্তম খেতাব পেয়েছিলেন।

রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সব কটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। সফল এই অপারেশনের ফলে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ পানিতে তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে আরও কিছু ছোট জাহাজ এবং পন্টুনেও বিস্ফোরণ হয়। প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুর আক্রমণের জন্য একদলে ছিলেন তিনজন করে।

মার্চ থেকে পাকিস্তান যুদ্ধ ও তাদের হত্যাযজ্ঞ অস্বীকার করে আসছিল। অপারেশন জ্যাকপট পাকিস্তানের প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। এমন অভিযানে শহরজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। আর বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক আনন্দ-উচ্ছ্বাস। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হন মুক্তিযোদ্ধারা। আর যুদ্ধের গতিপথ বদল করে দেয় এমন অভিযান। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

সেই শুরু। এরপর নভেম্বর মাস পর্যন্ত আরও বেশ কিছু অভিযান চালায় তারা। এতে সারা দেশে শতাধিক ছোট-বড় জাহাজ ধ্বংস করেছিলেন নৌ কমান্ডোরা। এভাবেই অপারেশন জ্যাকপট হয়ে ওঠে একাত্তরের অন্যতম কীর্তিগাথা।