বাবার সঙ্গে ফসলের খেতে কাজ করছেন তিন ভাই। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সরেঙ্গা গ্রামে মোহাম্মদ এয়াছিনের কৃষি খামারে
বাবার সঙ্গে ফসলের খেতে কাজ করছেন তিন ভাই। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সরেঙ্গা গ্রামে মোহাম্মদ এয়াছিনের কৃষি খামারে

শিক্ষিত ছেলেদের হাতে যেভাবে বদলে গেল পারিবারিক কৃষি খামার

অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেও বেকার বসেছিলেন নঈম উদ্দিন। কৃষক বাবা তাঁকে ঘরে না বসে থেকে পারিবারিক কৃষিকাজে যুক্ত হতে বলেন। বাবার কথায় নঈম খামারে কাজ শুরু করেন। কাজ করতে করতেই নঈম ভাবলেন খামারে হারভেস্টার, ট্রাক্টরসহ কৃষিযন্ত্র যুক্ত করলে উৎপাদনও যেমন বাড়বে, তেমনি কমবে শ্রমিকের খরচ। সেই ভাবনা থেকেই সরকারের ভর্তুকি দামে কম্বাইন হারভেস্টার কিনে তিনি ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দীর কাজ করে সফল হলেন।

এর পরের গল্প কেবলই সাফল্যের। গত ছয় বছরে তাঁদের খামারের আয় বেড়েছে ২০ গুণ। আগে পাঁচটি মহিষ ছিল তাঁদের। এখন আছে ৩৫টি। কেবল নিজেদের খামারের দেখাশোনা নয়, নঈমরা এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অন্য খামারের ফসল তুলে দিয়ে আয়ও করছেন।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সরেঙ্গা গ্রামে মোহাম্মদ এয়াছিনের কৃষি খামার। এয়াছিনের বড় ছেলে নঈম উদ্দিনের মতো এখন আরও দুই ছেলে শাহাব উদ্দিন এবং জসিম উদ্দিনও লেখাপড়ার পাশাপাশি কৃষিকাজে বাবাকে সহায়তা করছেন।

নঈম উদ্দিনকে কাজে সহায়তা করেন তাঁর দুই ভাই। শাহাব উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া কলেজে স্নাতক অধ্যয়নরত। তাঁরা ২৮ দিনের কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর এবং গ্রামীণ কারিগরি দক্ষতার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দুজনই নিজেদের সব যন্ত্রপাতি মেরামত ও কৃষি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ।

সম্প্রতি সরেঙ্গা গ্রামে এয়াছিনের খামারে গিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখা গেল। খামারভর্তি মহিষ, নানা ধরনের কৃষিযন্ত্র, জমিতে মাথা তোলা ফসল দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তিন ভাই আর তাঁদের বাবার যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। নিজেদের জমির বাইরেও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন কৃষককে কৃষিকাজে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেন তাঁরা।

কৃষক  মোহাম্মদ এয়াছিন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেরা বিশেষ করে বড় ছেলে খামারে যুক্ত হওয়ার পর চেহারা বদলে গেছে। আগে বছরে টেনে টুনে এক লাখ টাকায় হতো। এখন মাসেই এমন আয় হয়।

মোহাম্মদ এয়াছিনের বাবা ১৯৭৭ সালে ডাকাতের গুলিতে মারা যান। ওই সময় পরিবারে ৪০ কানি জমি ছিল। ওই জমি সম্বল করে কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, তিন ছেলে লেখাপড়া করে চাকরি করবে। কিন্তু তারাও এখন তাঁর মতোই কৃষক। লেখাপড়া করেও কেউ যে কৃষক হয়ে সফল হতে পারে তাঁর ছেলেরা সেই উদাহরণ তৈরি করেছে।

২০১৮ সালে উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের সহায়তায় একটি মিনি কম্বাইন হারভেস্টার কেনেন নঈম উদ্দিন। নিজেদের এবং আশপাশের চাষিদের জমির ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই ও বস্তাবন্দীর কাজ শুরু করেন সে সময়। লাভবান হওয়ায় ২০২০ সালে বড় একটি কম্বাইন হারভেস্টার কেনেন তিনি। লকডাউনের কারণে কৃষকেরা শ্রমিক–সংকটে পড়লে নঈম উদ্দিন তাঁর হারভেস্টার দিয়ে চাষিদের কাজ করে দেন। সে বছর তিনি একটি চারা রোপণ মেশিন (ওয়াকিং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার) কেনেন। লাভের টাকা থেকে ২০২৩ সালে আরও একটি বড় কম্বাইন হারভেস্টার কেনেন নঈম। ওই বছর আমন মৌসুমে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে ২৫ কানি জমিতে চারা রোপণ করেন। একই বছর দুটি রাইডিং টাইপ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কেনেন তিনি। চলতি বছর নিজেদের এলাকায় ১২৫ কানি জমিতে বোরো চাষে ধান লাগানোর কাজ করেছেন।

যেভাবে শুরু

খামারে মহিষের সংখ্যা ছিল ৫টি। তিনভাই কাজে যুক্ত হওয়ার পর এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫টিতে

২০১৭ সালে সরকারি সিটি কলেজ থেকে ইকোনমিকসে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন মোহাম্মদ এয়াছিনের বড় ছেলে নঈম উদ্দিন। চাকরি না পেয়ে বাবার পরামর্শে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, জেলার ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলার অন্তত ১৫০ কানি জমিতে মেশিন দিয়ে চারা রোপণের কাজ করেন তিনি।

কৃষিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে নঈম উদ্দিন বলেন, ‘বাবার পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিই নিজেদের জমির পাশাপাশি অন্যদের জমির কৃষিকাজেও বিনিয়োগ করব। বর্তমানে কৃষি থেকে বছরে আমাদের ২০ লাখ টাকার ওপরে আয় হয়।’ বাণিজ্যিকভাবে বীজ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত প্রযুক্তিগত সহায়তার এসব কাজ সাড়ে ১০ হাজার টাকার একটি প্যাকেজে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে তাঁদের।

২০১৮ সালে উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের সহায়তায় একটি মিনি কম্বাইন হারভেস্টার কেনেন নঈম উদ্দিন। নিজেদের এবং আশপাশের চাষিদের জমির ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই ও বস্তাবন্দীর কাজ শুরু করেন সে সময়। লাভবান হওয়ায় ২০২০ সালে বড় একটি কম্বাইন হারভেস্টার কেনেন তিনি। লকডাউনের কারণে কৃষকেরা শ্রমিক–সংকটে পড়লে নঈম উদ্দিন তাঁর হারভেস্টার দিয়ে চাষিদের কাজ করে দেন। সে বছর তিনি একটি চারা রোপণ মেশিন (ওয়াকিং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার) কেনেন। লাভের টাকা থেকে ২০২৩ সালে আরও একটি বড় কম্বাইন হারভেস্টার কেনেন নঈম। ওই বছর আমন মৌসুমে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে ২৫ কানি জমিতে চারা রোপণ করেন। একই বছর দুটি রাইডিং টাইপ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কেনেন তিনি। চলতি বছর নিজেদের এলাকায় ১২৫ কানি জমিতে বোরো চাষে ধান লাগানোর কাজ করেছেন তিনি।

বোরো মৌসুমে এলাকার চাষযোগ্য সব জমিতে ঢালাওভাবে পানি দিয়ে চাষের উপযোগী করে তোলেন নঈম উদ্দিন ও তাঁর বাবা মোহাম্মদ এয়াছিন। মোহাম্মদ এয়াছিন বলেন, ‘ধান কাটার পর চাষিরা পানি ও চারার টাকা দিলে নিই, না দিলে জোরাজুরি করি না। তাঁরা আমাদেরই পড়শি। আমরা না দেখলে তাদের কে দেখবে।’

খামারে যা যা আছে

বর্তমানে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন, ২২ লাখ টাকা মূল্যের দুটি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ৩০ লাখ টাকার দুটি ট্রাক্টর রয়েছে নঈম উদ্দিনের বাড়িতে। ৫০ লাখ টাকা দামের ৩৫টি মহিষ রয়েছে তাঁদের খামারে। বর্তমানে ১০টি মহিষ থেকে দুধ পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর ৫০ কানি জমিতে বোরো চাষের পাশাপাশি পাঁচ কানি জমিতে শর্ষে, দুই কানি জমিতে গম এবং এক কানি জমিতে মরিচ চাষ করেছেন তাঁরা।

তাঁরা তিন ভাই

নঈম উদ্দিনকে কাজে সহায়তা করেন তাঁর দুই ভাই। শাহাব উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া কলেজে স্নাতক অধ্যয়নরত। তাঁরা ২৮ দিনের কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর এবং গ্রামীণ কারিগরি দক্ষতার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দুজনই নিজেদের সব যন্ত্রপাতি মেরামত ও কৃষি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ।

আনোয়ারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমজান আলী বলেন, ‘কৃষিতে নিজেদের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি আশপাশের জমির কৃষিতেও অবদান রাখেন নঈম উদ্দিনের পরিবার। আশা করছি তাঁদের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসবেন কৃষি সম্প্রসারণে।’

বাবার সঙ্গে তিন ভাই। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সরেঙ্গা গ্রামে মোহাম্মদ এয়াছিনের কৃষি খামারে

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, ‘কৃষি নিয়ে নঈম উদ্দিনদের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ আমি পরিদর্শন করেছি। এভাবে শিক্ষিত তরুণেরা এগিয়ে এলে আমাদের কৃষি এগিয়ে যাবে।’

কৃষিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে নঈম উদ্দিন বলেন, ‘স্নাতকোত্তর পাসের পর চাকরি পাইনি। ভাবলাম একজন উদ্যোক্তা হব। সিদ্ধান্ত নিই, নিজেদের জমির পাশাপাশি আশপাশ থেকে আরও জমি নিয়ে কৃষিকাজ করব। কারণ, লাভের পাশাপাশি সম্মানজনক পেশা কৃষি। বর্তমানে আমাদের কোনো ঋণ নেই। বরং বছরে ২০ লাখ টাকার ওপরে আয় হচ্ছে।’