কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন আমিনা খাতুন। বন্দী ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন আমিনা খাতুন। বন্দী ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি

বন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ, উৎকণ্ঠায় স্বজনেরা

কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা আমিনা খাতুন। ১০ বছরের ছেলে ফারহানকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে। সেখানে ছিলেন বন্দী স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া অন্যরাও। কিন্তু কাউকেই দেখা করতে দিচ্ছিল না কারা কর্তৃপক্ষ। অন্য বন্দীদের স্বজনের কাছে আমিনা জানার চেষ্টা করছিলেন, বাইরে থেকে দেওয়া জামাকাপড়-টাকা বন্দীরা হাতে পাচ্ছেন কি না, কারাগারের ভেতরের অবস্থা কী, পরিস্থিতি কেমন—এসব।

আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কারাগারের ফটকের বাইরে কথা হয় আমিনা খাতুনের সঙ্গে। জানালেন, তাঁর বড় ছেলে নাজমুস সাকিব কারাগারে বন্দী। গত ২১ জুলাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ ছেলেকে আটক করে। কয়েক দিন থানার হাজতে রাখা হয়। পরে রিমান্ডে নিয়ে ২৭ জুলাই কারাগারে পাঠানো হয়। ছেলেকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আমিনা খাতুনের দাবি, ছেলে সাকিব রাগবি খেলোয়াড়। এখন রাগবি কোচিং করান। পাশাপাশি বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তিনি গত জুলাইয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন।

গ্রেপ্তারের বিষয়ে আমিনা খাতুন বলেন, ২১ জুলাই রাত ৯টার দিকে তাঁদের বাসায় হঠাৎ পুলিশ সদস্যরা যান। নিজের ছয়তলা বাসার তৃতীয় তলায় থাকেন তাঁরা। অন্য তলায় ভাড়াটেরা থাকেন। সেদিন তাঁর স্বামীকে নিয়ে পুলিশ সদস্যরা ছয়তলায় যান। সেখানে কয়েকজন চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থী ভাড়া থাকেন। স্বামী ক্যানসারের রোগী হওয়ায় সাকিবকেও পুলিশের সঙ্গে ওপরে পাঠানো হয়েছিল। পুলিশ সদস্যরা ছয়তলায় থাকা শিক্ষার্থীদের আটক করে থানায় নেওয়ার সময় সাকিবকেও নিয়ে যান। জানান, বাড়ির মালিক হিসেবে স্বাক্ষর করতে হবে তাঁকে।

কিন্তু সেদিন রাত ১২টা পেরিয়ে গেলেও বাসায় ফেরেননি সাকিব। পরে রাতেই থানায় যান মা আমিনা খাতুন। তখন পুলিশ সদস্যরা ধমক দিয়ে তাঁকে বাসায় পাঠিয়ে দেন। পরের দিন সকাল হতেই সাকিবের খেলার বিভিন্ন সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ সাকিবকে ছাড়েনি। কেন আটকে রেখেছে সেটাও বলেনি। আদালতে হাজিরের পর আমিনা জানতে পারেন, বিস্ফোরক আইনে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।

সন্তানের মুক্তির জন্য আকুতি জানিয়ে আমিনা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। যদি অন্যায় করত, তাঁর শাস্তি হতো। কিছু মনে করতাম না। কিন্তু এখন যা হচ্ছে সেটা শুধুই হয়রানি।’

বন্দী স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে কারাগারের ফটকের সামনে স্বজনদের ভিড়

‘বহুত হয়রানি হয়তাসি’

আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টির মধ্যেই কেউ ছাতা নিয়ে, কেউবা ভিজে ভিজে দাঁড়িয়ে আছেন ফটকের সামনে। অনেকে ফটকে দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীদের কাছে বন্দী স্বজনের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে জানতে চাচ্ছিলেন। তাঁদের সবাইকে বলা হচ্ছিল, দেখা করার সুযোগ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। দেখা করতে না পেরে অনেকেই কারাবন্দী স্বজনের জন্য কাপড়, ওষুধ কিংবা টাকা দিচ্ছিলেন। কারারক্ষীদের সেগুলো রসিদ কেটে রেখে দিতে দেখা যায়।

বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে না পারায় স্বজনদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। কেউ কেউ ক্ষোভ জানিয়ে বলছিলেন, অন্যায়ভাবে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ধরে আনা হচ্ছে। নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এখন দেখাও করতে দিচ্ছে না। কথাও বলতে দেওয়া হচ্ছে না।

সাক্ষাৎ বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কারারক্ষী প্রথম আলোকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ২০ জুলাই থেকে কারাবন্দীদের সঙ্গে স্বজনদের দেখা করতে দেওয়া বন্ধ রয়েছে। কবে থেকে দেখা করা যাবে, তা তাঁর জানা নেই।

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুভাষ কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, চলমান সহিংস পরিস্থিতির কারণে ১০ থেকে ১২ দিন ধরে কারাবন্দীদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ পাওয়ার পর আবার বন্দীরা তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাবেন।

স্বামী মোহাম্মদ দেলোয়ারের সঙ্গে দেখা করতে আজ কারাগারে গিয়েছিলেন মনোয়ারা বেগম। জানালেন, তাঁদের বাসা ডেমরার সারুলিয়া এলাকায়। সেখানেই স্বামীর মুদি পণ্যের দোকান। ২৪ জুলাই রাতে বাসা থেকে তাঁর স্বামীকে ধরে আনা হয়। পরদিন যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় ভাঙচুরের মামলায় তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ওইগুলো (যাত্রাবাড়ীর ভাঙচুর) কবে অইসে না অইসে আমরা কইতেই পারি না। এগুলো ঠিক না। মানুষেরে হয়রানি। অহনে বহুত হয়রানি হয়তাসি। হুদাহুদি (বিনা কারণে) নির্দোষ মানুষটারে ধইরা নিয়া আইসে।’

ছেলেকে গ্রেপ্তার, কারাগারে পাঠানো এবং কারাগারে দেখা করতে না দেওয়ায় ক্ষোভ জানালেন ভাষানটেক থানা আওয়ামী মোটরচালক লীগের সহসভাপতি পরিচয় দেওয়া জলিল মৃধাও। ছেলেকে নির্দোষ দাবি করে দলীয় পরিচয় দেওয়ার পরও মামলা ও কারাবাস থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে না পেরেই এ ক্ষোভ বলে জানান তিনি। তাঁর ছেলে জহিরুল ইসলামকে ২১ জুলাই দিবাগত রাত দুইটার দিকে বাসা থেকে আটক করে পুলিশ।

কারাগারের ফটকে বোর্ডে টাঙানো আটক আসামিদের তালিকায় নাম খুঁজছেন স্বজনেরা

জলিল মৃধার ভাষ্য, ‘জিগাইলাম কী মামলা দিছেন? কয় ভাঙচুর মামলা। আদালতে গিয়ে উকিলের মাধ্যমে কাগজপত্র তুললাম। দেহি মিরপুরে মেট্রোরেলের ভাঙচুর মামলা দিয়ে দিছে। কোনো কথাই হুনল না। ওসিরে ফোন দিলাম, কোনো কথাই শুনল না। বলে, ভাই কিছু করার নাই। হাই লেভেলের নির্দেশ। তাই বলে আমার নিষ্পাপ ছেলেরে ধইরা নিয়া যাইবেন?’

কারাগারের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কথা হয় অন্তত ২২ জন কারাবন্দীর স্বজনের সঙ্গে। তাঁদের কেউ বন্দী স্বজনের সঙ্গে দেখা করার আশায়, কেউ বা জরুরি জিনিসপত্র দিতে কারাগারে গিয়েছিলেন। কথা বলে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি সংঘর্ষের ঘটনায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী। কেউ পিকআপ ভ্যানচালক, কেউ চাকরিজীবী, কেউ দোকানি, কেউ আবার ব্যবসায়ী। স্বজনদের দাবি, তাঁরা আন্দোলন কিংবা সংঘর্ষে জড়িত ছিলেন না।

যাত্রাবাড়ীর কদমতলীর বাসিন্দা সাব্বির আহমেদের বাবা আনোয়ার হোসেন তো এখনো জানেনই না ছেলে কারাগারে না কোথায় আছে। শুধু জানালেন, ছেলে একটি ইলেকট্রিক দোকানের কর্মী। ২৬ জুলাই রাতে দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে পুলিশ সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।

কথা হয় মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়ার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগমের সঙ্গেও। তিনি জানান, তাঁর ছেলে মোহাম্মদ শামীম টিক্কাপাড়ায় একটি মুঠোফোন সামগ্রীর দোকান চালান। ২২ জুলাই সন্ধ্যায় নামাজ শেষে দোকান খুলতে গেলে মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ গিয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘পোলার মাইয়া সারা দিন “আব্বা কই, আব্বা কই” বইলা কান্দে। হেরে কেমনে বুঝাই, বাপে জেলে। পোলার সঙ্গে নিজে একবার দেহা করতে পারলেও মনে শান্তি হতো। এহন তো জানতেই পারতাসি না, পোলা ভালো আছে না খারাপ আছে।’