মুনীর চৌধুরী ও লিলি চৌধুরী
মুনীর চৌধুরী ও লিলি চৌধুরী

জন্মশতবর্ষে মুনীর চৌধুরী

আজ (২৭ নভেম্বর ২০২৪) অনন্যসাধারণ শিক্ষক, কৃতী ভাষাতত্ত্ববিদ, দৃষ্টি উন্মোচনকারী গবেষক, শ্রোতা সম্মোহনকারী বক্তা, এ দেশে আধুনিক নাটকের জনক শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর শততম জন্মদিন। ১৯২৫ সালের এই দিনে মুনীর চৌধুরী তাঁর পিতার কর্মস্থল মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।

মাত্র ৪৬ বছরের জীবন তাঁর; কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই প্রাগ্রসর চিন্তার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে কবর নাটকের রচয়িতার কবর রচিত হলো না। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত এ কৃতবিদ্য মানুষটির মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

১৯৫০ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে এবং কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন মুনীর চৌধুরী। শিক্ষক হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র–মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শিক্ষকদের সংগঠিত করতে তিনি উদ্যোগ নেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেপ্তার হন এবং দুই বছরের বেশি সময় তাঁকে কারান্তরালে কাটাতে হয়।

তবে এই কারাবাসের সময় তাঁর জীবনে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এক. একই সময়ে রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে কবর নাটক রচনা; আর দুই. অপর রাজবন্দী অধ্যাপক অজিত গুহের প্রেরণায় ১৯৫৩ সালে বাংলায় প্রাথমিক এমএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ।

একটি তালাকের কাহিনি ও অন্যান্য গল্প মুনীর চৌধুরী

কবর আমাদের দেশে প্রথম প্রতিবাদী নাটকের ধারার সূচনা করে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রগতিশীল সাংবাদিক-সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্তসহ বন্দী মুনীর চৌধুরীকে গোপনে একটি চিঠি পাঠিয়ে একুশের স্মরণে রাজবন্দীরা জেলখানার ভেতরে অভিনয় করতে পারে, এমন একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। নাট্যকারের যখন মঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে, মঞ্চায়নের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকে, তখন মঞ্চসফল নাটক লেখা সহজ হয়। কবর তার উজ্জ্বল উদাহরণ। মুনীর চৌধুরী ভাবলেন, সেট ও আলোর ব্যবস্থা থাকবে না, তাই সেই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি নাটকের ঘটনাস্থল হিসেবে বেছে নিলেন গোরস্তানকে, যেখানে সেটের প্রয়োজন নেই। নাটকের শুরুতেই নাট্যকারের নির্দেশ, ‘মঞ্চে কোনোরূপ উজ্জ্বল আলো ব্যবহৃত হইবে না। হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে।’ জেলখানায় নারী চরিত্রের অভিনেত্রী পাওয়া যাবে না বলে কবর নাটকে নাট্যকার কোনো নারী চরিত্র রাখেননি। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়।

অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর লেখা রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকটি অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। আমি তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্সে ভর্তি হয়েছি। হঠাৎ একদিন রাতে আমাদের হাউস টিউটর ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এসে আমাকে পরদিন মুনীর চৌধুরীর বাসায় যেতে বললেন। মুনীর চৌধুরী তাঁর নতুন নাটকে অভিনয় করতে পারে এমন কেউ জগন্নাথ হলে আছে কি না জিজ্ঞাসা করায়, গুহঠাকুরতা স্যার আমার নাম বলেছেন।

সেই থেকে মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। ক্রমে পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, তাঁর স্নেহের ভান্ডার উজাড় করে দিয়েছেন। আমরা লাভ করেছি তাঁর কাছ থেকে আমাদের অভিনয়জীবনের সত্যিকারের শিক্ষা। তাঁরই নির্দেশনায় চারটি নাটক করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল—রক্তাক্ত প্রান্তর, দণ্ড ও দণ্ডধর, কৃষ্ণকুমারী ও ভ্রান্তিবিলাস। তাঁর নির্দেশনার ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা রকমের। প্রথম দিন তিনি সব শিল্পীর সামনে পুরো নাটকটি পড়ে শোনাতেন। প্রতিটি চরিত্রের আলাদা আলাদা কথা বলার ধরন, অঙ্গভঙ্গি। তাঁর নাটকপাঠ এত প্রাণবন্ত হতো যে আমরা তা অনুকরণ করার লোভ সামলাতে পারতাম না। তবে শিল্পীর যে নিজস্ব একটি সত্তা আছে, তিনি তা অত্যন্ত বেশি অনুভব করতেন।

ঘরোয়া নাটকপাঠের আসরে মুনীর চৌধুরীকে দেখার সৌভাগ্য আমার অনেকবার হয়েছে। অভিনয়ের ব্যাপারে যখন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল, তখন প্রায়ই তিনি আমাদের সামনে তাঁর নতুন নাটক বা অন্য কোনো বিখ্যাত নাটক পড়ে শোনাতেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। মুনীর চৌধুরীর চেয়ে সুন্দর করে কাউকে নাটক পড়ে শোনাতে আমি জীবনে দেখিনি। আমার সঙ্গে হয়তো অনেকেই এ ব্যাপারে একমত হবেন।

কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে তিনি বাংলা টাইপরাইটারের জন্য উন্নত মানের কি-বোর্ড উদ্ভাবন করেন। পরে সেই টাইপরাইটার ‘মুনীর অপটিমা’ নামে জার্মান কোম্পানি বাজারজাত করে। এ সময়ে বাংলা বর্ণমালা ও বানানপদ্ধতির সংস্কার প্রচেষ্টা ও বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার বন্ধের বিরুদ্ধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক হিসেবে মুনীর চৌধুরীর খ্যাতি কিংবদন্তি পর্যায়ের। তাঁর ক্লাসে অন্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও এসে ভিড় জমাতেন। পাঠদান যে এত মন্ত্রমুগ্ধ করে দেওয়ার মতো হতো, তা তাঁর ছাত্ররা সব সময় উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া যেকোনো অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতা সেই ছাত্রজীবন থেকেই শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখত। ঢাকা টেলিভিশনে তিনি পুস্তক পর্যালোচনার একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেটিকেও দারুণ রসগ্রাহী করে উপস্থাপনা করতেন। ঢাকা টিভির প্রথম নাটক একতালা-দোতালা তাঁরই রচনা এবং আমারও সুযোগ হয়েছিল সেই নাটকে অভিনয় করার।

মুনীর চৌধুরীর অভাব আজ আমরা প্রতিটি পদে পদে অনুভব করছি। নাটকে, ক্লাসে, সভামঞ্চে, বেতারে, টেলিভিশনে, সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর তুলনীয় আর কাউকে পেলাম কোথায়?

আমরা আশা করব, জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ করে আমরা মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করব বিভিন্নভাবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে তুলে ধরব। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।