একটি পাহাড় কিনতে চেয়েছিলাম

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো আমারও একটা পাহাড় কেনার রোখ চেপেছিল বছর আটেক আগে। একটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গম্ভীর টাইপের নীলচে কালো পাহাড়; কিন্তু আমার মতো হতদরিদ্রের পক্ষে তা তো সম্ভব নয়। তাই খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলায় একটা ঝিরিঝিরি স্বচ্ছ ঝরনার পাশে আমি একটা পাহাড়ের অংশ দখলস্বত্বে কিনে মালিক বনে গেলাম। ভেবেছিলাম, ছোট্ট একটা কাঠের বাংলো করব। ঝরনার অপার জলের গান শুনে, হ্যামকে শুয়ে প্রিয় বইগুলো আবার পড়ব। গান শুনব। একান্ত নিজস্ব সময় কাটাব।

কিন্তু সচরাচর যেমনটি হয়, উপদেশদানে সবাই উন্মুখ; তাই সবাই বলল, আরে ফেলে রেখে লাভ কী! সেগুন, গামার, হরীতকী ও গর্জনগাছ লাগাও। আখেরে লাভ হবে।

তাই তো! দুটো পয়সা আসবে, আর আমি সেগুনকাঠ বেচে বাংলোটা বানিয়ে নেব। না পারলে ‘হোম স্টে’ বানিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও করা যাবে, যা কালিম্পংয়ে দেখে এসেছি। ছোট্ট ছোট্ট ছবির মতো হোম স্টে পাহাড়ের খাদের কিনারে, অনলাইন বুকিং ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেইমতো আমিও বন কেটে সেগুনগাছ লাগানো শুরু করলাম। মাঝেসাঝে তরণী হেডম্যানের (ছদ্মনাম), যাঁর কাছ থেকে দখলস্বত্বে পাহাড়ের অংশবিশেষ কিনেছিলাম, সঙ্গে মুঠোফোনে বাতচিত হতো, জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘আরে কাক্কু, সব ঠিক।’ কিন্তু আমার মনের দ্বিধা যায় না।

২০২১ সালে আমার সেই পাহাড়ে গেলাম। তখন হেমন্তকাল, পাহাড়ে ফসলের ঘ্রাণ। গাড়িতে কিছু দূর গিয়ে বাকি কিছুটা খাড়া পথ ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে সেখানে পৌঁছাতে পারলাম। চারদিকে এত হইচই, লোকসমাগম ও উচ্চ স্বরে গান বাজছে। তাকিয়ে দেখি, আমার সাধের পাহাড়টা যেন ময়লার ভাগাড়। আমার সেই সেগুনগাছগুলো কোথায় গেল?

তরণী হেডম্যানকে মুঠোফোনে পেলাম না। কোনো কোনো হেডম্যানের একটা বিরল গুণ আছে (সবার নয় কিন্তু), একই পাহাড় তিনি অনেকজনের কাছে দখলস্বত্ব বিক্রি করে দেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার বাইকার জসীম ত্রিপুরা কাগজ দেখে আশ্বস্ত করলেন, ‘না কাকা, আপনারটা মনে হয় এ রকম হয়নি।’

 তরণী হেডম্যানের কিশোরী মেয়ের সঙ্গে এক টংঘরে সাক্ষাৎ।  জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘বাবা তো হোগে (জুমে) গেছে। ওখানে ইদানীং বানরের উৎপাত খুব। জুমের সব ফসল খেয়ে ফেলে। বাবাকে দিন–রাত পাহারায় থাকতে হয়। ওখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই।’ কিশোরী বলল, বাবা এই এল; কিন্তু বুঝলাম, সহজে তিনি আর আমার সামনে আসছেন না। অনেকক্ষণ বসে টংঘরের সদাইপাতি দেখে চলে এলাম।

আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। খাগড়াছড়িতে আমার জন্ম। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এখন ঢাকার উত্তরায় বসবাস করছি। ভেবেছিলাম, অবসরজীবনটা পাহাড় আর গাছপালা নিয়ে থাকব। সে স্বপ্ন এখনো বিসর্জন দিইনি।

আমি আমার শখমতো পাহাড়টি সাজাতে না পারলেও আমার এক মামা ঠিকই পেরেছেন। তিনি শখ করে বেশ পয়সাপাতি খরচা করেই পাহাড়ের খাঁজে নানা রকম হুমকি সামলে একটি রঙিন মনোরম কাঠের বাংলো বানিয়েছেন। পাকা সড়কের পাশ দিয়ে বিলাসী এসি বাসে ও ব্যক্তিগত বিলাসবহুল গাড়িতে যাওয়ার সময় এই বাংলো সবার নজর কাড়ছে। মামা আছেন বিপদে, ধনাঢ্য পর্যটকেরা ভেতরে এসে থাকতে চান, অন্তত পশ্চিমের খোলা রোয়াকে বসে আদিগন্ত পাহাড় দেখে আয়েশি ভঙ্গিতে কফির পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়াতে চান; কিন্তু মামা ব্যাংকার হলেও পাক্কা বেনিয়া হয়ে উঠতে পারেননি।

আমি কানে কানে মন্ত্র দিলাম—মামা হোম স্টে করে দাও না, খরচাপাতি তো উঠে আসবে। মামা চোখ সরু করে বিটলা ভাগনের দিকে খরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। যদিও বয়সে আমিই বড়!

মামা শখের হোগ বা জুম করেছেন। পাকা ধানের গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। আমাকে নিয়ে অসুস্থ শরীরেও নবান্নের সীমিত উৎসব করলেন। মামার জুমের পাকা ধানের ঘ্রাণে ঝাঁক বেঁধে প্রত্যুষে বনমোরগের দল উঠানে জড়ো হয়ে হইহল্লা করে। হয়তো দখলদারত্বের প্রতিবাদ জানায়। আমি বনমোরগের ঝাঁক শেষ কবে দেখেছি মনে নেই। মামাকে বলেছি, ‘মামা, প্লিজ তুমি ওদের খেতে দাও। ফাঁদ পেতে কাউকে ধরতে দিয়ো না। ওরাও বাঁচুক তোমার সঙ্গে। তোমার কত মণ ধানই-বা ওরা শেষ করবে।’

লেখাটি যখন লিখছি (মে ২০২৪), তখন মামা আরও অসুস্থ। মামা, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। আগামী শরতে তোমার উঠানে বনমোরগ ও তামাসার (একধরনের বুনো পাখি) ঝাঁক, কাঠবিড়ালির চকিত চাহনি দেখতে চাই আবার।