কলকাতার যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছে, সেই ফ্ল্যাটের বাইরে সিসি ক্যামেরা ধরা পড়া এই ফুটেজ সংগ্রহ করেছে কলকাতা পুলিশ
কলকাতার যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছে, সেই ফ্ল্যাটের বাইরে সিসি ক্যামেরা ধরা পড়া এই ফুটেজ সংগ্রহ করেছে কলকাতা পুলিশ

শিমুল–ফয়সালের সঙ্গে ফ্ল্যাটে ঢোকেন আনোয়ারুল, পরে বের হয় তিনটি ট্রলি ব্যাগ

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার আগে কলকাতার বরাহনগরের মণ্ডলপাড়া লেন থেকে নিউ টাউন এলাকায় নেওয়া হয়। নজরদারি এড়াতে অন্য একটি গাড়িতে করে তাঁকে নেওয়া হয় ওই এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনসে। ১৩ মে বেলা ৩টা ১০ মিনিটে সঞ্জিভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে প্রবেশের পর সেখান থেকে আর বের হতে দেখা যায়নি আনোয়ারুলকে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে ওই ফ্ল্যাট থেকে চলে আসেন সৈয়দ আমানুল্লাহ (প্রকৃত নাম শিমুল ভূঁইয়া) ও শিলাস্তি রহমান। আর ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে ফ্ল্যাটটি ছাড়েন জিহাদ হাওলাদার।

জিহাদ নীল রঙের একটি বড় ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছিলেন। শিমুল ও শিলাস্তির বের হওয়ার সময়ও তাঁদের কাছে দুটি ভারী ট্রলি ব্যাগ ছিল। এ ছাড়া এর মধ্যে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়া ব্যক্তিদের কাছে আরও তিনটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ছিল। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট পুলিশের ধারণা, এসব ট্রলি ও প্লাস্টিক ব্যাগেই আনোয়ারুল আজীমের খণ্ডিত মরদেহ সরানো হয়ে থাকতে পারে।

শিমুল, শিলাস্তি ও জিহাদ—এই তিনজনই আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়েছেন। শিমুল ও শিলাস্তি বর্তমানে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে আছেন। আর জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁরা তিনজনই আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। কলকাতা পুলিশ সূত্র বলছে, পেশায় কসাই জিহাদ সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের মরদেহ কেটে টুকরা টুকরা করেছিলেন। মরদেহ উদ্ধারে জিহাদকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে কলকাতা পুলিশ।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম

কলকাতা পুলিশের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, আনোয়ারুল আজীম কলকাতার মণ্ডলপাড়া লেনের বন্ধুর বাসা থেকে বের হন ১৩ মে বেলা ১টা ৪০ মিনিটে। এরপর একটি ধূসর রঙের গাড়িতে (হোন্ডা অ্যামেজ) চড়েন। ওই গাড়িতে থাকা ফয়সাল আলী ওরফে সাজী (খুলনার ফুলতলায় বাড়ি) নামের এক ব্যক্তি তাঁকে নিয়ে ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে নিউ টাউন এলাকার অ্যাক্সিস মলের কাছে যান। ২টা ৪০ মিনিটে দুজনই গাড়ি থেকে নেমে অন্য একটি গাড়িতে ওঠেন। ওই গাড়িতে আগে থেকে ছিলেন সৈয়দ আমানুল্লাহ (শিমুল ভূঁইয়া)। এই তিনজন বেলা ৩টা ৫ মিনিটে গিয়ে সঞ্জিভা গার্ডেনসে নেমে ৩টা ১০ মিনিটে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন।

এসব ঘটনা উল্লেখ করে ২২ মে নিউ টাউন থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ। তদন্তে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে সেখানকার পুলিশ এ ঘটনায় সাতজনের সম্পৃক্ততার কথা জানতে পেরেছে। তবে এর বাইরেও আনোয়ারুল হত্যায় কেউ জড়িত থাকতে পারেন।

১৩ দিন আগেই গাড়ি ভাড়া করেন শিমুল

কলকাতার পুলিশ বলছে, সংসদ সদস্য খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গে ৩০ এপ্রিল কলকাতায় গিয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করেন শিমুল ভূঁইয়া। এই গাড়ির চালক ছিলেন সিদ্ধার্থ কুন্ডু। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চালক জানান, সঞ্জিভা গার্ডেনসে ফ্ল্যাট ভাড়ার নেওয়ার মধ্যস্থতাকারী বীরেন ভদ্রের মাধ্যমে গাড়িটি ভাড়া করা হয়েছিল।

৬ মে আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের নির্দেশে সিদ্ধার্থ চিনারপার্ক এলাকা থেকে জিহাদকে তুলে কাইখালীর হোটেল ও টু–তে নিয়ে যান। আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন আক্তারুজ্জামান ও শিলাস্তি রহমান। সেখানে রাতের খাবারের পর সবাইকে নামিয়ে দেওয়া হয় সঞ্জিভা গার্ডেনসে। তখন জিহাদ আর তাঁদের সঙ্গে যাননি।
এরপর ১৩ মে শিমুল ওই গাড়ি নিয়ে কলকাতার নিউ টাউনের অ্যাক্সিস মলের সামনে যান। বেলা ৩টা ৫ মিনিটে সেখান থেকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে উঠিয়ে নিয়ে তাঁরা সঞ্জিভা গার্ডেনসে গিয়ে নামেন।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আক্তারুজ্জামান শাহীন

এর আগে বরাহনগরের মণ্ডলপাড়া লেন থেকে আনোয়ারুল আজীম যে গাড়িতে করে নিউ টাউনে এসেছিলেন, সেটির চালক ছিলেন নাজিব খান। নাজিবকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, কলকাতার নিউমার্কেট এলাকা থেকে গাড়িটি ভাড়া করেন ফয়সাল আলী। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মো. মুস্তাফিজুর রহমান (বাড়ি খুলনার ফুলতলায়) নামের আরেকজন। ফয়সাল ও মুস্তাফিজুর ২ মে থেকেই নিউমার্কেট এলাকার ‘হোটেল প্লাজা’য় অবস্থান করছিলেন।

লাশের খণ্ড ও ট্রলি ব্যাগ কোথায়

সংসদ সদস্যকে ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া চালক সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কলকাতার পুলিশ জানতে পারে, আনোয়ারুলকে খুনের পরদিন ১৪ মে সঞ্জিভা গার্ডেনস থেকে বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি জিহাদ হাওলাদার ওরফে জুবায়েরকে গাড়িতে তোলেন। সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁকে ‘গুপ্ত টি স্টল’ নামের একটি দোকানের কাছে নামিয়ে দেন। তখন জিহাদের সঙ্গে একটি নীল বড় ট্রলি ব্যাগ ছিল।

পুলিশের কাছে দেওয়া সঞ্জিভা গার্ডেনসের তত্ত্বাবধায়কের বক্তব্য বলছে, শিমুল ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান ১৪ মে সকাল ১০টায় ভাড়া করা রাইড শেয়ারিং সার্ভিস ওলা অথবা উবারের গাড়িতে সঞ্জিভা গার্ডেনস ত্যাগ করেন। তখন এই দুজনও বড় ট্রলি ব্যাগ বহন করছিলেন।

এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ জানতে পেরেছে, খণ্ডিত লাশের বড় অংশ ফেলা হয়েছে কলকাতার কেষ্টপুর খালে। মরদেহটির অংশ খুঁজতে দফায় দফায় কাজ করছে কলকাতার পুলিশ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের থেকেও তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া হাতিশালা বর্জ্যখালেও এর একটি অংশ ফেলা হতে পারে বলে তথ্য রয়েছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। এটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ শুক্রবার গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদারকে নিয়ে কলকাতার একাধিক খালে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ।