কূটনীতির টানাপোড়েন নিরসনে জোর দিতে হবে

ঘটনাবহুল ২০২৩ সাল শেষ হলো। আজ শুরু হলো যে বছর, তাতে কী প্রত্যাশা বাংলাদেশের? যে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে শেষ হয়েছে ২০২৩—তারই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, নাকি স্বস্তি আসবে সাধারণ মানুষের জীবনে, কোনো সুবাতাস বইবে রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক সম্পর্কে?

আজ থেকে ছয় দিন পর ৭ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচন হবে বাংলাদেশে। কেমন হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন, এর উত্তর মোটামুটি জানা। প্রতিযোগিতামূলক দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থীর বিপক্ষে দলটির স্বতন্ত্র বা ‘ডামি’ প্রার্থীর অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এতে ভোটার উপস্থিতি সম্ভবত কিছুটা বাড়বে। এই স্বতন্ত্রদের মধ্যে অনেকে জিতে আসারও সম্ভাবনা আছে। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। কারণ, আখেরে তাঁরা আওয়ামী লীগেরই সদস্য।

নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হবে, সেখানে জাতীয় পার্টির কয়েকজন আর জোটসঙ্গীদের দু–চারজন ছাড়া বাকি সবাই থাকবেন আওয়ামী লীগের। বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে, দেখতে হবে পররাষ্ট্রনীতিতে এই সরকারের অগ্রাধিকার কী হয়।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পররাষ্ট্র বিষয়ে আটটি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আমার কাছে। একটির ভাষ্য, দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা এবং অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা চলমান থাকবে। অন্যটিতে উন্নয়ন অর্থায়নের ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

দক্ষিণ আমেরিকায় ঠিক উন্নয়ন অর্থায়নের মতো উদ্বৃত্ত সামর্থ্যের দেশ তেমন চোখে পড়ে না। আর চীন, রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত খুব সহজ নয়। সহজ শর্তে ঋণের জন্য তাই আমাদের নির্ভরশীলতা থেকে যাবে উন্নত বিশ্ব এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ওপরই। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক তাই উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ থেকে যাবে। দেখতে হবে নির্বাচন–উত্তরকালে কতটা সহজ হবে সে কাজ।

আলাদা আলাদা কারণে নির্বাচন প্রশ্নে ভারত, চীন ও রাশিয়া দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে সরকারকে, তিন দেশই প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করুক। পক্ষান্তরে নির্বাচনটি স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো যেভাবে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ হোক চেয়েছে, তেমনটি হচ্ছে না।

এর মধ্যে মার্কিন সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্তকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা বিধিনিষেধ এবং শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে রেখেছে। এসব কারণে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এবং সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে শক্ত ভাষায় সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের সঙ্গে চলমান সম্পর্ক খুব মসৃণ, এ কথা ঠিক বলা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন তো যা হওয়ার তা হয়ে যাবে, সে নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে পশ্চিমা দুনিয়ায়? পশ্চিম কি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো বিষয়টি পেছনে ফেলে স্বাভাবিক আদান–প্রদান এবং সহযোগিতা জারি রাখবে, নাকি কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার পথে এগোবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, আর কেউ জানেন কি না, তা–ও নিশ্চিত নই। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা এলে তা মোকাবিলা করতে পারবে বাংলাদেশ, তার মানে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না সরকার।

আমার মনে হয় এটা নির্ভর করবে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার ধরনের ওপর। যদি তা হয় শুধুই ভিসা নিষেধাজ্ঞা, এর প্রভাব মোকাবিলা করতে পারবে সরকার। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, কিন্তু বড় কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। তবে কোনো ধরনের আর্থিক বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এলে, তার প্রভাব হবে ব্যাপক। যত বড় বড় কথা বলি না কেন আমরা, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি খুব শক্তিশালী নয়। একটিমাত্র পণ্য আমাদের রপ্তানির প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে। আর সেই পণ্যের বাজারের সিংহভাগ পশ্চিমের কয়েকটি দেশ, যাদের সঙ্গে আমরা বাক্‌যুদ্ধে জড়িয়েছি।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যে গুরুত্ব কখনোই কমবে না। চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। তবে এর কোনোটাই পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের বিকল্প নয়। নিজেদের স্বার্থেই পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসন করে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বাংলাদেশকে।

  •  মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব