আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। একাত্তরের অব্যবহিত পরে ১৯৭৪ সালে আমার জন্ম। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের যে গ্রামে আমি জন্মেছি, তার নাম কামার হাট।
আর যখনকার কথা বলছি, তখন এ গ্রামকে অজপাড়াগাঁ বলা হতো।
তো প্রথমেই বলা যাক, এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে পেয়েছিলাম আমি।
বোধবুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে অভিহিত হতে দেখেছি ‘গন্ডগোলের বছর’ হিসেবে। সাধারণ অর্থে ‘গন্ডগোল’ একটি নেতিবাচক শব্দ। গন্ডগোল বলতে মোটাদাগে আমরা ঝামেলাপূর্ণ কিছুকেই বুঝে থাকি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কি ঝামেলাজনক কোনো বিষয়?
নিশ্চয় নয়। তবে আমরা যখন জন্মেছি এবং যে সময় থেকে আমাদের প্রজন্ম বুঝতে শিখেছে, তত দিনে সপরিবার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন হয়ে গেছে। বিকৃত হতে শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। যে প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, আমি তাদের একজন।
স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছি। যার পরিপ্রেক্ষিতে কখনো কখনো মনে অনেক প্রশ্ন এসেছে। কিন্তু সেসব প্রশ্নের উত্তর তখন পাইনি।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, সেই গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সে সময় কি এমন কেউ ছিলেন না, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্যমূলক সত্য ইতিহাস আমার সামনে তুলে ধরতে পারেন?
উত্তর হলো, ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার মতো বাস্তব অবস্থায় হয়তো ছিলেন না। অন্তত আমি যে পরিপার্শ্বের মধ্যে বেড়ে উঠেছি, সেখানে এমন কাউকে পাইনি। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে আমার ও আমার প্রজন্মের বড় হওয়া।
পরে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শেষে ১৯৯২ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হলাম, এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ ছবিটি আমার সামনে ধীরে ধীরে বিস্তারিত ক্যানভাসসমেত ধরা দিতে শুরু করল। মূলত তখনই বুঝতে পারলাম, মুক্তিযুদ্ধ কী, কেন হয়েছিল, এখানে কার কী অবদান ছিল ইত্যাদি। কিন্তু তত দিনে মুক্তিযুদ্ধের দুই দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।
এ কথা বলা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না, শৈশব-কৈশোরে সেই যে শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ মানে ‘গন্ডগোলের বছর’, তা থেকে পরিপ্রেক্ষিতসহ এই যুদ্ধের পরিপূর্ণ ইতিহাস বুঝতে বুঝতে আমার ২০ বছরের বেশি সময় লেগে গেছে।
সন্দেহ নেই, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি বা সংস্কৃতিক্ষেত্রে আমাদের যে অর্জন, তার পেছনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অবদান সবচেয়ে বেশি। ব্যক্তিগতভাবে যদি বলি, শিক্ষক পিতার সন্তান হয়ে কামার হাট গ্রাম থেকে পড়ালেখার সূত্রে আমি যে ঢাকায় এলাম এবং পরে অভিনয়শিল্পে নিয়োজিত হলাম, দেশ স্বাধীন না হলে আমার মতো গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন প্রতিনিধির ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটত কি না সন্দেহ।
হ্যাঁ, জাতীয় পর্যায় ও ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে। কিন্তু এখন যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একাত্তরের সেই রক্তে লেখা অধ্যায়কে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব?
একটা দেশ যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, তখন সেই দেশের বিভিন্ন স্তরের নানান পেশাজীবী মানুষ একাত্ম হয়ে তাতে শামিল হন। আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধ খুব দ্রুতই জনযুদ্ধে রূপ লাভ করে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখানে কেউ অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছেন, আর বাকিরা যুদ্ধ করেছেন যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে। একাত্তরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সবার মধ্যে জেগে উঠেছিল প্রবল দেশাত্মবোধ-দেশপ্রেম। যে কারণে সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের যাঁর যা কর্তব্য, তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এভাবেই।
তবে একাত্তর-পরবর্তী সময়ে আমরা কি আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছি? প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে গেলে দেখতে পাই, আমাদের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই রয়েছে দেশপ্রেমের ঘাটতি।
না, সবার কথা বলছি না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে সার্বিক দেশপ্রেমের চেয়ে আমাদের মধ্যে এখন আত্মপ্রেম বা নিজের লাভালাভ চিন্তা যে বেশি কাজ করে, তা-ও তো অস্বীকার করতে পারি না।
আমার কাছে দেশপ্রেমের অর্থ হলো, যারা যে যে ক্ষেত্রে নিয়োজিত আছি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের কাজটি যেন আমরা সৎভাবে পালন করি।
যে মানুষ তার কাজে অসৎ, সে তো দেশপ্রেমিক হতে পারে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যদি দেশপ্রেমিক হতো এবং নিজের কাজটি ঠিকঠাকভাবে করত, তাহলে অনেক সমস্যাই মিটে যেত।
এখন আমরা প্রচণ্ডভাবে বিভাজিত, নানান বর্গে বিভক্ত, কোনো ইস্যুতেই আর এক হতে পারি না। এটাও দেশপ্রেম না থাকারই নমুনা। নিজস্ব স্বার্থচিন্তা আমাদের আর এক হতে দেয় না। ফলে ‘স্বাধীনতা’এখন একটি শুষ্ক শব্দে পর্যবসিত হয়েছে। এর যে বিস্তারিত দ্যোতনা রয়েছে, আমাদের জীবনাচরণ ও কাজে তার কতটুকুই-বা প্রতিফলিত হয়?
দেশপ্রেমকে আত্মস্থ করতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাজাত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলতে পারব।
চঞ্চল চৌধুরী: অভিনয়শিল্পী।