বন্যার প্রভাব চালের বাজারে পড়তে শুরু করেছে। এক মাসে মোটা চালের দাম কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে সরকারি গুদামে চালের মজুতও গত বছরের তুলনায় বেশ কম। বন্যায় আমন ও আউশ ধানেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবার বিশ্ববাজারে চালের দাম দেশের বাজারের চেয়ে বেশি। ফলে আমদানির সম্ভাবনাও কম।
সব মিলিয়ে আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত চালের বাজারে অস্থিরতা থাকতে পারে।
তবে নভেম্বরে আমন কাটা শুরু হলে চালের দাম কমতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ থেকে বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এমনটা বলা হয়েছে।
বাজার ও সরবরাহব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকে, তা তদারক করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। গরিব মানুষের জন্য সরকারি চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে।কে এ এস মুর্শিদ, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস
বাংলাদেশ গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট, আগস্ট–২০২৪ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ আন্দোলনের সময় মাসখানেক খাদ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে চালের বাজারে। তবে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্দোলনের প্রভাব পড়েনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ৩০ আগস্ট প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে বন্যায় ধানের ব্যাপক ক্ষতির কারণে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চালের উৎপাদন ৩ শতাংশ কমতে পারে। এই অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন হতে পারে। ধান হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের চেয়ে সাড়ে ৩ শতাংশ কম। বছরে মোট চালের চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ টনের বেশি।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি গুদাম ও ব্যবসায়ীদের কাছে কী পরিমাণ চাল মজুত আছে, তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই। ইউএসডিএর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাজারে চালের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। কারণ, বেসরকারি খাতে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪৭ শতাংশ কম চাল মজুত আছে।
সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল রয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২২ দশমিক ১ শতাংশ কম। তবে সরকারি সূত্র বলছে, আগামী তিন মাসের জন্য এই মজুত যথেষ্ট।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি গুদাম ও ব্যবসায়ীদের কাছে কী পরিমাণ চাল মজুত আছে, তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই। ইউএসডিএর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাজারে চালের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। কারণ, বেসরকারি খাতে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪৭ শতাংশ কম চাল মজুত আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার কারণে ধানের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তা সামগ্রিকভাবে চালের চাহিদা মেটাতে বড় কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। কারণ, সরকারি গুদামে যথেষ্ট পরিমাণ চালের মজুত আছে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী কয়েক মাস চালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে। অক্টোবরে আমন ধান কাটা শুরু হলে দাম কমতে পারে। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারে দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে চাল আমদানি করা কঠিন হবে।
দেশে সাধারণত আউশ, আমন ও বোরো— তিনটি মৌসুমে ধানের চাষ হয়। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমন ধান রোপণ করা হয়। আর তা কাটা হয় নভেম্বর–ডিসেম্বরে। বর্ষা দেরিতে আসায় এবং আগস্টজুড়ে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় এবার আমনের চাষ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমনের চারা দেরিতে রোপণ করা হলে মোট উৎপাদন কিছুটা কমতে পারে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী কয়েক মাস চালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে। অক্টোবরে আমন ধান কাটা শুরু হলে দাম কমতে পারে। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারে দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে চাল আমদানি করা কঠিন হবে। এদিকে ভারত চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এখনো তুলে নেয়নি।
বাংলাদেশে চালের সরকারি মজুত ও বাজার মূল্য অনেক সংবেদনশীল বিষয়। আগস্ট–সেপ্টেম্বরে এমনিতেই চালের দাম একটু বাড়ে। কিন্তু বন্যার কারণে সরবরাহে একটু ঘাটতি হতে পারে। এটা বুঝে ব্যবসায়ীরা হয়তো দাম আরেকটু বাড়িয়েছেন।বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোরো ধান সাধারণত ডিসেম্বর–জানুয়ারি মাসে রোপণ করা হয়। আর এপ্রিল–মে মাসে তা কাটা হয়। সাধারণত বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বিপদ আসে। খরা থেকে শুরু করে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় ও পোকার আক্রমণ এ সময় বেশি হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর ৩৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এখান থেকে দুই কোটি পাঁচ লাখ টন চালের উৎপাদন হতে পারে।
আউশ মৌসুমে এবার ৯ লাখ হেক্টর জমিতে ২১ লাখ টন ধান হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ কম। আউশের ভরা মৌসুম জুন–জুলাই মাসে আকস্মিক বন্যা হয়েছে। আগস্টে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় হঠাৎ বন্যার কারণে ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশের উজানে ভারত থেকে আসা ঢলের কারণে মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া ও গোমতী নদীর তীরবর্তী এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী দুই লাখ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ১০ আগস্টের মধ্যে ৬০ শতাংশ আমন ধান রোপণ করা হয়। এরপর বন্যা শুরু হয়ে যাওয়ায় চারা রোপণ ব্যাহত হয়েছে। বন্যা শুরু হওয়ার পর চালের দাম বাড়তে শুরু করে। ওই সময় চালের কেজি ৫২ টাকা হয়, যা এর আগের ১ মাসের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। আর সরু চালের কেজি ৭১ টাকা হয়। পরে দাম আরও বাড়তে থাকে।
এদিকে চাল আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের সময়কাল শেষ হয়ে গেছে। গত বছরের আগস্টে সরকারের পক্ষ থেকে চাল আমদানির ওপর ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে ২৫ শতাংশ করা হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে চালের সরকারি মজুত ও বাজার মূল্য অনেক সংবেদনশীল বিষয়। আগস্ট–সেপ্টেম্বরে এমনিতেই চালের দাম একটু বাড়ে। কিন্তু বন্যার কারণে সরবরাহে একটু ঘাটতি হতে পারে। এটা বুঝে ব্যবসায়ীরা হয়তো দাম আরেকটু বাড়িয়েছেন। ফলে বাজার ও সরবরাহব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকে, তা তদারক করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। গরিব মানুষের জন্য সরকারি চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে।