পুড়ে গেলে চেনা ঘরও অচেনা হয়ে যায়। যেমন হয়েছে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ৫ আগস্টের পর। এখন শুধু বাড়িটির কাঠামোই আছে। তিনতলার ঘরে ময়লার স্তূপে পড়ে আছে ডালাখোলা ভাঙা একটি লাল স্যুটকেস। ধ্বংস হয়ে গেছে বাড়ির তিনটি তলায় জমানো সব ঐতিহাসিক ও পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন।
স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জন্ম ও ১৯৭৫ সালের ঘটনা পার হয়ে ২০২৪ সালে আবারও এক ইতিহাস জন্মাল ৬৩ বছর বয়সী বাড়িটি নিয়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে যায় ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান। সেদিন ৩২ নম্বরের এ বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
ইতিহাসের বাড়ি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন ১৯৬১ সালের অক্টোবরে। এরপর এই বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ইতিহাসের নানা প্রবাহ। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা নানা আন্দোলনের পথ ধরে এসে ঠেকে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে। এরপর একে একে আসে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আর ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ৩২ নম্বরের এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্দেশনা দিতেন, জনসংযোগ চালাতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ৩২ নম্বর বাড়ি থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫০–এর দশকে মুজিব পরিবারের ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জায়গা ছিল না। রাজনৈতিক কারণে অনেকেই পরিবারটিকে বাসা ভাড়া দিতে অনীহা দেখাতেন। ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালে তাঁর একান্ত সচিব নূরুজ্জামান বেগম মুজিবের অনুরোধে ধানমন্ডি এলাকার জমির জন্য গণপূর্ত বিভাগে আবেদনপত্র জমা দেন। ১৯৫৭ সালে ছয় হাজার টাকায় ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমি বরাদ্দ পান তাঁরা। সেখানে প্রথমে দুই কক্ষবিশিষ্ট একতলা বাড়ি তোলা হয়। বাড়িটিতে তখন মাত্র দুটি শোবার ঘর ছিল। একটিতে থাকতেন সস্ত্রীক শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যটিতে তাঁর মেয়েরা। একটি রান্নাঘর বানানো হয়েছিল। সেটির একপাশে থাকতেন তাঁর দুই ছেলে।
১৯৬৬ সালে দোতলায় পরিবারটির বসবাস শুরু হলে নিচতলার নিজেদের শোবার ঘরটি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল ছোট একটি কক্ষ। সেটি ব্যবহৃত হতো ড্রয়িং রুম হিসেবে। তৃতীয় তলা তৈরি হয়েছে বহু পরে।
পুড়ে যাওয়ার আগে পুরো বাড়িটিকেই রূপান্তর করা হয়েছিল জাদুঘরে। প্রতিটি কক্ষ ছিল ঐতিহাসিক নানা স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে সাজানো।
ইতিহাসের দলিল
পুড়ে যাওয়া বাড়িটির দায়িত্বে থাকা ছাত্ররা জানান, আগুন লাগার খবর শুনে তাঁরা এসেছেন যতটা সম্ভব স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষা করতে। ঘটনার পরদিন কেউ কেউ এসে কিছু বই ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন বলে জানান তাঁরা। তাঁরা জানান, নিজেদের তাগিদেই তাঁরা বাড়িটি পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছেন।
জাদুঘরে থাকা বিভিন্ন প্রদর্শনসামগ্রীর মধ্যে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহার করা পাইপ, চশমাসহ পরিবারের বিভিন্ন তৈজস। ছিল শেখ রাসেলের খেলনা। ছিল নিহত হওয়ার সময় মুজিব পরিবারের সদস্যদের গায়ে থাকা পোশাকগুলো। এখন সবই প্রায় ভস্ম। কিছু লুটপাটও হয়েছে।
দগ্ধীভূত বাড়িটির ভেতর চোখে পড়ল ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো নির্দেশনা লেখা টাইপ করা কাগজের ছেঁড়া পাতার টুকরো অংশ।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি আবার হস্তান্তর করা হয়। বাড়িটিকে তিনি জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। এর নাম হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’। মূল বাড়িটির পেছনে জাদুঘরের জন্য ছয়তলা আরেকটি ভবনও তৈরি করা হয়। জাদুঘরের উদ্বোধন হয় ২০১১ সালে।
জাদুঘরের সহকারী কিউরেটর কাজি আফরিন জাহান ২০০৬ সাল থেকে এ জাদুঘরের সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, জাদুঘরের ১০ হাজারের বেশি নিদর্শনের সবই ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
বুলেটের দাগে আগুন
এ বাড়ির বাইরে ধানমন্ডি লেকের ধার ঘেঁষে উন্মুক্ত চত্বর। সেখানে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল। সেটি এখন অন্তর্হিত। বাড়ির প্রবেশপথে নিচতলায় ছিল আরেকটি ম্যুরাল। সেটির মুখ বিনষ্ট।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাড়িটির দোতলার সিঁড়িতে বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়েছিলেন শেখ মুজিব। দেয়ালে সেই বুলেটগুলোর চিহ্ন ছিল কাচ দিয়ে আবৃত। কাচ ভেঙে সেসব দাগ এখন উন্মুক্ত।
১৯৮১ সালে বাড়িটি ফিরে পাওয়ার সময়ও দোতলার সিঁড়িতে ছিল শেখ মুজিবের রক্তের দাগ। সে দাগ অক্ষুণ্ন ছিল এতগুলো বছর ধরে। এবারের আগুন মুছে দিয়েছে সেই রক্তচিহ্ন।
একই আগুনে পুড়ে গেছে বাড়িটির সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের বহু স্মারক।