নারায়ণগঞ্জে দুর্গাপূজা মানে ভিন্ন এক শহর। শহরের অলিগলিতে আলোকসজ্জা, তোরণ, ঢাকঢোল ও কাঁসরের ধ্বনি আর মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ঘুরে হাজারো মানুষের উদ্যাপন।
এবার সেই উদ্যাপনে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে শহরের টানবাজার সাহাপাড়া পূজামণ্ডপ। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ঢাকার বঙ্গবাজারের ২৫৪টি বেনারসি শাড়ি দিয়ে এবার মণ্ডপটি সাজানো হয়েছে। আর এর পেছনের মানুষ তরুণ নকশাকার রোহান খান।
‘শাড়ি মানেই তো মায়ের আঁচল, বোনের আদর, প্রিয়তমার ভালোবাসা। শাড়ি মানেই তো নারী। সেই শাড়ি পোড়া হলেও ফেলনা নয়।’ বলছিলেন রোহান। ‘আগমনীর আলো’ শিরোনামে করা মণ্ডপটিতে পোড়া শাড়ির পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন পাটখড়িসহ পরিবেশবান্ধব সব উপকরণ। এ ছাড়া পূজামণ্ডপে কালো কাপড় ব্যবহার করে সমবেদনা জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি। সেই সঙ্গে করেছেন নারীশক্তির বন্দনা।
এসব শাড়ি কেনার কারণে ব্যবসায়ীদের যে খুব উপকার হয়েছে, তা কিন্তু নয়। তাঁদের ক্ষতির কাছে এটা খুবই সামান্য। আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা করেছি মাত্র। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সহমর্মিতার একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া গেল।টানবাজার সাহাপাড়া নতুন পূজা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সুমন সাহা
রোববার মহাঅষ্টমীর দিনে সড়কের আলোকসজ্জা পেরিয়ে মণ্ডপটিতে ঢুকতেই দেখা গেল বাহারি রঙের বেনারসিতে সজ্জিত মণ্ডপ। মণ্ডপের দেয়ালে কালো কাপড়ের মাঝে পাটখড়িতে তৈরি নারীর অবয়ব। দেবী দুর্গার পরনেও বাহারি নকশার ঝলমলে বেনারসিসদৃশ শাড়ি। দুর্গার পেছনে তুলা দিয়ে তৈরি চক্র। যেখানে স্থাপন করা হয়েছে ১০ জন দেবতার প্রতিকৃতি।
নানা বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশু মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে দেখছে। প্রতিমা ও মণ্ডপের নকশার সঙ্গে ছবি তুলছেন কেউ কেউ। আবার কেউ আয়োজকদের কাছে মণ্ডপসজ্জায় পোড়া শাড়ি ব্যবহারের কারণ জেনে নিচ্ছেন। আয়োজকেরাও দর্শনার্থীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন সহমর্মিতা, পরিবেশ রক্ষা ও নারীশক্তির বার্তা।
সেখানেই কথা হয় নকশাকার রোহান খানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এ বছর জামদানি দিয়ে মণ্ডপ সাজানোর ইচ্ছা ছিল। আমরা যখন থিম নিয়ে ভাবছি, তখনই আগুনের ঘটনা। পূজা উদ্যাপন কমিটি তখন সিদ্ধান্ত নিল, জামদানির বদলে আগুনে পোড়া বেনারসি ব্যবহার হবে মণ্ডপে। আমরা ন্যায্যমূল্যে ২৫৪টি পোড়া শাড়ি সংগ্রহ করে তা দিয়েই মণ্ডপ তৈরির কাজ শুরু করি।’
আয়োজকেরা জানালেন, ২০ বছর ধরে তাঁরা সাহাপাড়ায় দুর্গাপূজার আয়োজন করছেন। এর মধ্যে টানা ছয় বছর রোহান খানের ইভেন্ট টাচ সাহাপাড়া মণ্ডপসজ্জায় আছে। এর আগে তাঁরা পাট, সুতা, কাগজ, বাঁশ, বেত ও পোড়ামাটিতে মণ্ডপ সাজিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
ব্যবসায়ীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে মণ্ডপসজ্জায় কালো রঙের ব্যবহার হয়েছে। রোহান বলেন, ‘অশুভ শক্তির প্রতীক হওয়ায় মণ্ডপে সাধারণত কালো রং বর্জন করা হয়। কিন্তু আমরা শোকের প্রতীক হিসেবে কালো রং ব্যবহার করেছি।
সেই সঙ্গে কালো কাপড়ের ওপর পাটখড়ি দিয়ে নারীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই নারীরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এর অর্থ হলো আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনে যে অন্ধকার আছে, তা থেকে মুক্তির আশায় মানুষ নারীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুর্গা কিংবা মাতৃশক্তিই পারে এই অন্ধকার দূর করতে।’
আয়োজকেরা জানালেন, ২০ বছর ধরে তাঁরা সাহাপাড়ায় দুর্গাপূজার আয়োজন করছেন। এর মধ্যে টানা ছয় বছর রোহান খানের ইভেন্ট টাচ সাহাপাড়া মণ্ডপসজ্জায় আছে। এর আগে তাঁরা পাট, সুতা, কাগজ, বাঁশ, বেত ও পোড়ামাটিতে মণ্ডপ সাজিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
টানবাজার সাহাপাড়া নতুন পূজা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সুমন সাহা বলেন, ‘এসব শাড়ি কেনার কারণে ব্যবসায়ীদের যে খুব উপকার হয়েছে, তা কিন্তু নয়। তাঁদের ক্ষতির কাছে এটা খুবই সামান্য। আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা করেছি মাত্র। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সহমর্মিতার একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া গেল।’
মণ্ডপটিতে তাঁরা সচেতনভাবে কর্কশিট ও প্লাস্টিক পরিহার করেন বলে জানান আয়োজক কমিটির আরেক সদস্য সৌরভ সাহা, ‘শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষেই আমাদের মণ্ডপ। চোখের সামনে নদীটি নষ্ট হয়ে গেল। যেহেতু নদীতেই প্রতিমা বিসর্জন হয়, তাই আমরা পূজার সজ্জায় পরিবেশবান্ধব পচনশীল বস্তু ব্যবহার করি।’
ব্যতিক্রমী এই সজ্জা দেখে সন্তুষ্ট দর্শনার্থীরাও। পরিবার নিয়ে মণ্ডপে আসা পপি রানী সরকারের কথায়, ‘আমরা তো এমন একটি সমাজই চাই, যেখানে মানুষ মানুষের পাশে থাকবে, পরিবেশ নষ্ট করবে না, আর নারীসহ সব মানুষ তাদের যথাযথ মর্যাদা পাবে।’