এবার বেশ আগেই নির্বাচন নিয়ে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। চীন, রাশিয়ার পর ভারতও এখন নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কংগ্রেস সদস্য এখন ঢাকায়। গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করে গেছেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়কারী। এ মাসেই আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো–প্যাসিফিক কমান্ডের পরিচালক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদল এসে ছিল দুই সপ্তাহের বেশি সময় আগে।
বছরখানেক ধরে পাশ্চাত্য দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরে আগ্রহের একটা বড় দিক ছিল বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদও রয়েছে তাদের। এত দিন নীরব থাকলেও সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দেশটি নির্ধারিত সময়ে শান্তিপূর্ণ ভোটের কথা বলেছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বৈশ্বিক বিভিন্ন উদ্যোগ, আগ্রহ ও তৎপরতা বাড়ছে। যদিও এর আগে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর তৎপরতার নানামুখী সমালোচনায় যুক্ত হয় চীন ও রাশিয়া।
বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল মুখোমুখি অবস্থানে আছে। এরই মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অবস্থান ও তৎপরতা নিয়ে সরকারের মধ্যে একধরনের অস্বস্তিও তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, এ ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের অবস্থান সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের জন্য স্বস্তিদায়ক।
সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবস্থান ধরে রাখতে হলে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, মানবাধিকার ও বৃহত্তর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো সমুন্নত রাখতে হবে।মো. হুমায়ূন কবীর, সাবেক রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বৈশ্বিক তৎপরতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে গত মে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যদিও দুই দেশের বহুমাত্রিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার নানা কার্যক্রমও পাশাপাশি চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল এখন বাংলাদেশ সফর করছে। হাওয়াই থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড কেইস ও জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেস সদস্য রিচার্ড ম্যাকরমিক গতকাল শনিবার ঢাকায় পৌঁছেছেন।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দুই কংগ্রেস সদস্য কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি দেখতে এসেছেন।
যদিও তাঁরা ঢাকায় অবস্থানের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। কূটনীতিকেরা মনে করছেন, এসব মতবিনিময়ের সময় মার্কিন দুই রাজনীতিক বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সম্পর্কে জানা-বোঝার চেষ্টা করবেন।
এর আগে গত সপ্তাহে দুর্নীতি দমন বিষয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়কারী রিচার্ড ন্যাপিউ। এ মাসের শেষের দিকে প্রতিরক্ষা সংলাপে যোগ দিতে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো–প্যাসিফিক কমান্ডের কৌশলগত পরিকল্পনা ও নীতিবিষয়ক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টমাস জেমস। আগামী মাসের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি (টিকফা) সংক্রান্ত পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসবেন মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। এ ছাড়া অক্টোবরে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা চলছে।
ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা বহুমাত্রিক হয়েছে। মোটা দাগে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে মানবাধিকার ও সুশাসন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, অপ্রচলিত নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। এর মধ্যে মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা; সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতাকারীদের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপসংক্রান্ত ভিসা নীতি ঘোষণা এরই প্রতিফলন।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, অতীতের তুলনায় এবার বেশ আগেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের দেশগুলো শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চর্চায় জোর দিয়ে আসছে। যুক্তরাজ্য ও ইইউ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা বলে আসছে। গত মাসে ইইউর প্রাক্নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে গেছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে আগামী মাসে ইইউর ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
ভারত চায় বাংলাদেশের নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সে দেশের জনগণ নির্ধারণ করবেন। ভারত আশা করে, শান্তিপূর্ণভাবে এই নির্বাচন পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে।ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী
বাংলাদেশের নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, এমন প্রত্যাশা নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলো সরব থাকলেও প্রতিবেশী ভারত এত দিন নীরব ছিল। এমনকি রাশিয়া ও চীন সাধারণত অন্য দেশের নির্বাচন নিয়ে কথা না বললেও এবার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন দেখা গেছে। সম্প্রতি রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করেছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে গত শুক্রবার দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ আসে। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী এ নিয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানান। তবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অবস্থান রয়েছে।
এর আগের সপ্তাহের ব্রিফিংয়ে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে অরিন্দম বাগচী বলেছিলেন, ভারত চায় বাংলাদেশের নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সে দেশের জনগণ নির্ধারণ করবেন। ভারত আশা করে, শান্তিপূর্ণভাবে এই নির্বাচন পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে।
এদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত সপ্তাহে দিল্লি সফর করে। ফিরে এসে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিদলের প্রধান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সফরে তাঁরা জেনেছেন যে ভারত বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়।
অবশ্য বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে ভারতের সহমত আছে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক মো. হুমায়ূন কবীর। তাঁর মতে, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করে। তাই এখানে ভারতের কোনো পক্ষ নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না।
বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কূটনীতিকদের বক্তব্য সরকারকে বেশ কিছুদিন ধরেই অসন্তুষ্ট করে আসছে। সরকারের সঙ্গে এ বিষয়গুলোতে পশ্চিমা কূটনীতিকদের মতপার্থক্যের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় ইইউসহ ১৩ বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূতদের যৌথ বিবৃতি। ওই বিবৃতির পর নজিরবিহীনভাবে একসঙ্গে ১৩ কূটনীতিককে গত ২৬ জুলাই তলব করা হয়। এ সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো.শাহরিয়ার আলম যৌথ বিবৃতির বিষয়ে সরকারের অসন্তোষের কথা জানান। এ সময় ভিয়েনা সনদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘অকূটনৈতিক’ আচরণ থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান। সেদিনের আলোচনায় কূটনীতিকেরা কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান অটুট থাকার কথাও জানিয়েছেন।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট মো. হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে বিশ্ব সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে দেখে। সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবস্থান ধরে রাখতে হলে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, মানবাধিকার ও বৃহত্তর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো সমুন্নত রাখতে হবে।