হামলা–অগ্নিসংযোগের পর নরসিংদী কারাগার
হামলা–অগ্নিসংযোগের পর নরসিংদী কারাগার

জেলপালানো ৯০৯ বন্দী এখনো ধরা পড়েননি, নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি

নরসিংদী সদর উপজেলার নুরালাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরির কাজ করতেন ফারুক আহমেদ (৪৩)। পরে তিনি জঙ্গিবাদে যুক্ত হন বলে অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ র‍্যাব-৯ গ্রেপ্তার করে তাঁকে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর আদালত ফারুককে নরসিংদী কারাগারে পাঠান। এরপর গত জুলাইয়ে সেখান থেকে পালান তিনি। তবে পাঁচ দিনের মাথায় (২৪ জুলাই) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে তিনি আবারও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই শত শত মানুষ মিছিল নিয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা-অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় সেলের তালা ভেঙে ফেললে ৮২৫ বন্দীর সঙ্গে কারাগার থেকে পালিয়ে যান ফারুক আহমেদও।

কারাগার সূত্র বলছে, পলাতক বন্দীদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, এই বন্দীদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ব্যক্তিরা আবার নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন, যা আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণ হতে পারে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার আগে–পরে দেশের কয়েকটি কারাগারে বিশৃঙ্খলা–বিদ্রোহ করেন বন্দীরা। নরসিংদী কারাগারসহ কোনো কোনোটিতে চালানো হয় বাইরে থেকে হামলা–ভাঙচুর। এ পরিস্থিতিতে পাঁচটি কারাগার থেকে ২ হাজার ২৪১ বন্দী পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়া বন্দীসহ বিচারাধীন মামলার আসামিরা আছেন।

বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এসব বন্দী ও আসামির মধ্যে ১ হাজার ৩৩২ জনকে গত শনিবার পর্যন্ত কারাগারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এখনো পলাতক আছেন ৯০৯ জন।

কারাগার সূত্র বলছে, পলাতক বন্দীদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, এই বন্দীদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ব্যক্তিরা আবার নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন, যা আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণ হতে পারে।

এসব বিষয়ে শনিবার যোগাযোগ করা হলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা বিশৃঙ্খলা করে পালিয়েছিল, এরই মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের অনেককে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আবার অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন।

যাঁরা বিশৃঙ্খলা করে পালিয়েছিল, এরই মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেককে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আবার অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। পাঁচ শতাধিক বন্দীকে এখন কারাগারে ফেরাতে বা আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন, কারা মহাপরিদর্শক

মো. মোতাহের হোসেন আরও বলেন, পালিয়ে যাওয়া পাঁচ শতাধিক বন্দীকে এখন কারাগারে ফেরাতে বা আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। ধীরে ধীরে সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

কারা অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, পালিয়ে যাওয়া বন্দীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য দেশের প্রতিটি ইমিগ্রেশনে তাঁদের বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান যৌথ অভিযানেও তাঁদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।

যেসব কারাগার থেকে বন্দী পলায়ন

কারাগার সূত্রগুলো জানায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে–পরে পাঁচটি কারাগার থেকে পালিয়েছেন বন্দীরা। এর মধ্যে চারটিতেই বন্দীরা ভেতর থেকে বিশৃঙ্খলা–বিদ্রোহ করেন।

কাশিমপুর কারাগার এলাকায় সাঁজোয়া যান নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন সেনাসদস্যরা

এ পাঁচ কারাগারের একটি নরসিংদী জেলা কারাগার। সেখানে ১৯ জুলাই কয়েক শ লোক বাইরে থেকে কারা ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে সেলগুলো খুলে দেন। ধরিয়ে দেন আগুন। এতে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ বন্দী পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ৬১৯ জনের মতো আত্মসমর্পণ করেছেন। এ ছাড়া, তিন জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং এখনো ২০৪ জন পলাতক আছেন বলে জানিয়েছেন নরসিংদী জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. শামীম ইকবাল।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি পক্ষ সুযোগ নিয়ে এই পলাতক বন্দীদের দিয়ে দেশে অরাজকতা ও গোলমাল সৃষ্টি করবে। দাগি বন্দীরা অপরাধে যুক্ত হলে দেশের জন্য খুব ক্ষতি হবে। তাঁরা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বন্দীদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়িয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে তাঁদের।
শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী, কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের খবর দেশের কারাগারগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়লে যে কয়টিতে বন্দীরা মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ–বিদ্রোহ করেন, সেগুলোর একটি গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার। ৬ আগস্ট বিদ্রোহ শুরু করেন তাঁরা। একপর্যায়ে ২০৩ বন্দী পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে ৮৪ জন মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ব্যক্তি। শনিবার পর্যন্ত এ কারাগারের ২০০ বন্দী ফেরত আসেননি।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তাঁরা জেনেছেন। প্রক্রিয়া শেষে দুজনকে কারাগারে ফেরত আনা হয়েছে। ওই ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

৫ আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েক শ লোক সাতক্ষীরা কারাগারের সীমানাপ্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তাঁরা প্রধান ফটকসহ কারাগারের সব সেলের তালা ভেঙে ৫৯৬ বন্দীকে বের করে নিয়ে যান। কারাগারটির তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এনায়েতউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ৫২৯ বন্দী আত্মসমর্পণ ও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন ২ নারীসহ ৬৭ বন্দী পলাতক আছেন।

একই দিন বিকেলে শেরপুর জেলা কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন দুর্বৃত্তরা। এ সুযোগে ৫১৮ বন্দী পালিয়ে যান। শনিবার কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, এখন পর্যন্ত ৯১ বন্দী আত্মসমর্পণ করেছেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ বন্দীকে। এখনো পলাতক ৪১২ বন্দী।

বগুড়া জেলা কারাগারে বালতির হাতল ও স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করে ছাদ ফুটো করে পালিয়েছিলেন ফাঁসির চার আসামি

এদিকে, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের দুই দিন পর ৭ আগস্ট দুপুরে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে বন্দীরা বিদ্রোহ করেন। একপর্যায়ে কারারক্ষীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৯৮ বন্দী পালিয়ে যান। শনিবার কারা তত্ত্বাবধায়ক আ. বারিক প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত ৭২ বন্দী গ্রেপ্তার হয়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন। ২৬ বন্দী পলাতক আছেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বন্দী ফিরে এসেছেন। যেসব বন্দীর সাজা কম ও অর্ধেক সাজা খেটেছেন তাঁরা কারাগারে ফেরত এসেছেন। যাঁরা জঙ্গি, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত, দাগি আসামি, তাঁরা ফেরত আসেননি। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে আছেন। এটা সবার জন্য ক্ষতিকর।

শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী আরও বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি পক্ষ সুযোগ নিয়ে এই পলাতক বন্দীদের দিয়ে দেশে অরাজকতা ও গোলমাল সৃষ্টি করবে। দাগি বন্দীরা অপরাধে যুক্ত হলে দেশের জন্য খুব ক্ষতি হবে। তাঁরা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বন্দীদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়িয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে তাঁদের।