‘জাতীয় সংলাপে’ বিশিষ্টজনেরা

সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই

সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতাবিষয়ক জাতীয় সংলাপ’ অনুষ্ঠানে বক্তারা। ঢাকা, ৯ অক্টোবর
ছবি: দীপু মালাকার

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই। অনমনীয় অবস্থানে থেকে আলোচনা করা যায় না। চলমান সংকটের সমাধান করতে হলে সবাইকে ছাড় দিতে হবে। বড় দুই দলের মধ্যে এমন একটি বোঝাপড়া হতে পারে যে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে না।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আজ সোমবার সকালে ‘রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতাবিষয়ক জাতীয় সংলাপ’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহযোগিতায় এ সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও অংশ নেন।

বড় দুই দলের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতা হতে হবে, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই উল্লেখ করে সংলাপে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, বিরোধ হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে। কেউ একবার ক্ষমতায় গেলে তা আর ছাড়তে চান না। অবস্থা এমন হয়েছে, যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ। তিনি বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার দরকার। কিন্তু শুধু আইনি সংস্কার করেই সমস্যার সমাধান হবে না। বড় দুই দলের মধ্যে এমন একটি বোঝাপড়া হতে পারে যে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে না।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের বড় দুই দলের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য আছে বলে জানান রওনক জাহান। নিজের এ বক্তব্যের পক্ষে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি, নিজ সংসদীয় এলাকার উন্নয়নের জন্য আর্থিক বরাদ্দ পাওয়া-এসব বিষয়ে বড় দুই দলের নেতাদের মধ্যে ঐকমত্য আছে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তিত না হলে প্রকৃত পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করেন রওনক জাহান। তিনি বলেন, ‘আমাদের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট সিস্টেমটা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আমরা অনেক কষ্ট করে, চিন্তা করে ভাবলাম কেয়ারটেকার করলে হয়তোবা নিরপেক্ষ একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু তারপর আমরা দেখলাম যে নিরপেক্ষ নির্বাচন, কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট কীভাবে পার্টিজান (দলীয়করণ) করা যায়, তার চেষ্টা।’

বড় দুই দলের মধ্যে এমন একটি বোঝাপড়া হতে পারে যে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে না।
—রওনক জাহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

রওনক জাহান বলেন, ‘আমরা যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে তিন মাসের জন্য নির্বাচন ফেয়ার (সুষ্ঠু) করবে, সেটার জন্য বিশ্বাস না করতে পারি, তাহলে পাঁচ বছর বসিয়ে দিলাম...আমরা কী করে বিশ্বাস করব তারা নিরপেক্ষ থাকবে?’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, কোনো জনপ্রতিনিধি মারা গেলে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ছেলে-মেয়ে বা স্ত্রী নির্বাচন করছেন, এটিও একটি ট্রেন্ড (প্রবণতা) হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
সংলাপে সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, ’৯০-এ তিন জোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল, আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সমস্যার সমাধান করা হবে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা সেটা ভুলে গেছেন। সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।

‘সবাইকে ছাড় দিতে হবে’

নির্বাচন প্রশ্নে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ১৯৯১ সালে একবার রাজনৈতিক সমাধান (ঐকমত্য) হয়। ২০০৬ সালে নতুন সংকট তৈরি হয়। ২০১৪ সাল থেকে আবার সংকট চলছে। এই সংকটের শুরু হয়েছে ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। এখন পরিস্থিতি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’–এ (ফিরে আসার উপায় নেই) চলে গেছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার।

বৃহত্তর সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প নেই মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, অনমনীয় অবস্থানে থেকে আলোচনা করা যায় না। সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ায় এক-এগারো এসেছিল।

নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা কিন্তু কমিশন কি তা বাস্তবায়ন করতে পারছে—সে প্রশ্নও তুলেছেন আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মের কারণে ভোট গ্রহণ স্থগিত (গত বছরের ১২ অক্টোবর) করেছিল কমিশন। এরপর তদন্তে অনেকের দায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংলাপে স্বাগত বক্তব্যে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও দেশে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যকর করা যায়নি। তাঁরা আশা করেন, এ বিষয়ে রাজনীতিবিদেরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। সুজনের পক্ষ থেকে একটি নাগরিক সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। তাঁরা কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মধ্য দিয়ে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। যাঁরা সংলাপে বসতে রাজি নন, তাঁরা মূলত সংকট এড়িয়ে যেতে চান।

দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা হওয়া দরকার বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক। তিনি বলেন, নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। সব দলকে বিদেশিদের দালালি করা বন্ধ করতে হবে। সংকট সমাধান করতে হলে সবাইকে ছাড় দিতে হবে, আস্থা রাখতে হবে।

‘সংলাপের কোনো লক্ষণও নেই’

সংলাপে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, যেকোনো উপায়ে একটি নির্বাচন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হবে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচিতে সংলাপ হতে পারে। কিন্তু সে সংলাপ কে আহ্বান করবে? সংলাপের কোনো লক্ষণও নেই। বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একটি ভালো নির্বাচন করতে না পারলে দেশ দীর্ঘমেয়াদি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পড়ে যাবে বলে মনে করেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন। তাঁর মতে, ভালো নির্বাচনের জন্য পুরো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে।

এর আগে আটটি বিভাগীয় সংলাপ আয়োজন করেছিল হাঙ্গার প্রজেক্ট ও সুজন। সেখানে আসা রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

অন্যদের মধ্যে বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক এবং সুজনের বিভিন্ন বিভাগের সভাপতি-সম্পাদকেরা বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আওয়ামী লীগ চাইলেও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না। কারণ, এখানে আরও অনেক পক্ষের সংযুক্তি আছে।