চট্টগ্রামের রাউজানের জলিল নগরের আপন বাড়ি রেস্তোরাঁয় গত সোমবার যেন আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জোয়ার বইছিল। রেস্তোরাঁর ১০০ জন শ্রমিক-কর্মচারী প্রত্যেকেই মিষ্টিমুখ করছেন। এমন খুশির কারণ এইচএসসির ফল। রেস্তোরাঁর তিন তরুণ কর্মী এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁদের সবাই পাস করেছেন। কেবল পাস নয়, তাঁদের মধ্যে একজন জিপিএ-৫ও পেয়েছেন। বাকিদের ফলও বেশ ভালো। সারা দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে তিন তরুণ কখন পড়াশোনা করলেন, সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছেন তাঁদের সহকর্মীরা।
তিন তরুণের এমন তাক লাগানো ফলে গোটা উপজেলায় অন্য রকম উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে। উপজেলার বাসিন্দারা অদম্য এই মেধাবীদের কৃতিত্ব তুলে ধরছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিনন্দন ও শুভকামনায় ভাসছেন তিন তরুণ।
ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রেস্তোরাঁয় কাজ করেন সুলতান।সন্ধ্যায় মেসে ফিরে পড়ালেখা করতেন। সপ্তাহে দুই দিন রেস্তোরাঁর মালিক থেকেছুটি নিয়ে কলেজে যেতেন। এভাবে তাঁর এগিয়ে যাওয়া
ভোলার চরফ্যাশনে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন মুহাম্মদ রাকিবের (২০) বাবা। বাবার টানাটানির সংসারে থেকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছিলেন। একসময় বাবা পড়ালেখার খরচ জোগান দিতে পারেননি। পরে কাজের সন্ধানে ঘর ছাড়েন রাকিব। চলে আসেন চট্টগ্রামের রাউজানে। কাজ নেন আপন বাড়ি রেস্তোরাঁয় শ্রমিক হিসেবে। সেখানে কাজ করে এসএসসিও পাস করেন জিপিএ–৪.৩০ পেয়ে। এরপর রোজগারের টাকায় ভর্তি হন চরফ্যাশন সরকারি কলেজে। আবার চলে আসেন রাউজান আপন বাড়ি রেস্তোরাঁয়। ক্লাস শুরু হলে সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস করতে যেতেন রাকিব। এভাবেই চলছিল তাঁর লেখাপড়া, চাকরি। গত সোমবার এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ হলে রাকিব নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি, মুঠোফোনে এই তথ্য জেনে তাই কান্না ধরে রাখতে পারেননি।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ওই রেস্তোরাঁয় রাকিবের খোঁজ নিতে গেলে জানা যায়, ফলাফল পেয়েই রাকিব মা–বাবার কাছে ছুটে গেছেন। মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, এক জেলায় চাকরি আর আরেক জেলায় পড়ালেখা। এভাবে সবকিছু চালিয়ে নিতে হয়েছে তাঁকে। সাহায্য করেছেন পরিবারকেও। তবে সফল হওয়ায় কঠিন দিনগুলোকে এখন মধুর মনে হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে লেখাপড়া কীভাবে চালিয়ে নেবেন, জানেন না তিনি। পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। কেউ পাশে দাঁড়ালে হয়তো কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারবেন।
রাকিবের মতো রেস্তোরাঁর আরও দুই কর্মী তারেকুল ইসলাম ও সুলতান মাহমুদও এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছেন। এর মধ্যে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে তারিকুল ৪.৫৮ পেয়ে আলিম(এইচএসসি) পাস করেছেন। আর সুলতান ৩.৯২ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়ার একটি কলেজ থেকে।
রেস্তোরাঁয় গিয়ে দুজনকে পাওয়া গেলেও কথা বলার ফুরসত মিলল না শুরুতে। দুজনই ব্যস্ত ‘কাস্টমার’ সামলাতে। একজন ভাত আনছেন, অন্যজন ছুটে গিয়ে অন্য কোনো অর্ডার নিচ্ছেন। জমজমাট রেস্তোরাঁটিতে তখন কয়েক শ গ্রাহক একসঙ্গে খাচ্ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে গ্রাহক কমে আসায় কথা বলার অবসর মেলে তাঁদের।
তারেকুল জানান, তাঁর বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়ায় ইউনিয়নের নাপিত পুকুরিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা কৃষক। তিনি মাদ্রাসার জেডিসি পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে তিনি এই রেস্তোরাঁয় কাজ নেন। এরপর থেকে এখানে শ্রমিকের কাজ করার পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে নিচ্ছিলেন। এভাবে দাখিল পাস করেন। এবারের আলিমেও ফল ভালো হয়েছে তাঁর। কৃষক বাবা নুর আহমদের সংসারের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট তারেকুল। তিনি এবার পটিয়ার শাহ চান্দ আওলিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।
তারেকুল প্রথম আলোকে বলেন, এই পর্যন্ত আসার পথটা অনেক কঠিন ছিল। তাঁর বাড়ি রাঙ্গুনিয়া, চাকরি করেন রাউজানে আর পড়তেন পটিয়ার মাদ্রাসায়। এভাবে তিন উপজেলা ঘুরে ঘুরে তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন। তাঁর স্বপ্ন উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো কোনো চাকরি করবেন। পরিবারে সচ্ছলতা আনবেন।
তারেকুল সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনো সুলতান মাহমুদ রেস্তোরাঁর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর ফাঁকেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সুলতান জানালেন, তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নে। তাঁর বাবা মহিউদ্দিনও কৃষক। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সুলতান মাহমুদ। পড়তেন চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া শহীদ এন এম ডি ডিগ্রি কলেজে। তিনিও দুই উপজেলা ও মহানগর ঘুরে পরিবার, চাকরি সামলে পড়েছেন।
সুনতান প্রথম আলোকে বলেন, ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রেস্তোরাঁয় কাজ করেন তিনি। সন্ধ্যায় মেসে ফিরে পড়ালেখা করতেন। সপ্তাহে দুই দিন রেস্তোরাঁর মালিক থেকে ছুটি নিয়ে কলেজে যেতেন। এভাবে তাঁর এগিয়ে যাওয়া। তাঁর স্বপ্ন উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো কিছু হওয়ার।
আপন বাড়ি রেস্তোরাঁর মালিক আবুল হোসেন তিন কর্মীর ভালো ফলে ভীষণ উচ্ছ্বসিত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি কর্মচারী আছে। আমি কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করি। তিনজন শিক্ষার্থীকে সব রকম সহযোগিতা করেছি আমরা। ফলাফল প্রকাশের পর তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছি। তারা উচ্চশিক্ষা নিতে চাইলে আমরা সব সহযোগিতা করব।’