‘জিম্মি থাকা নাবিকদের একটু স্মার্টলি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে’

‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর এর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। ২৩ নাবিক, ক্রুসহ জাহাজটি জিম্মি করেছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা
ছবি: সংগৃহীত

সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক ও ক্রুর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের স্বজনেরা বেশ উদ্বেগে রয়েছেন। শঙ্কায় রয়েছেন জাহাজের মালিকসহ সবাই। এর আগে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন জার্মান জাহাজ মারিডা মার্গারিটার প্রধান কর্মকর্তা বাংলাদেশি জাফর ইকবাল। এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বললেন, ‘জিম্মি থাকা নাবিকদের একটু স্মার্টলি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এটা সত্য, তাঁদের চরম মানসিক চাপে রাখবে।’

এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কবির গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি। ওই সময় জাহাজটিতে ২৫ জন নাবিক-ক্রু ও প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী ছিলেন। অপহরণের ১০০ দিন পরে, ২০১১ সালের ১৩ মার্চ ভোরে জলদস্যুরা পণবন্দীদের মুক্তি দেয়।

তারও কিছুদিন আগে জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হন জাফর ইকবাল। মারিডা মার্গারিটার ২২ জন নাবিক-ক্রুকে জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তাঁদের মধ্যে জাফর ইকবালসহ দুজন বাংলাদেশি ছিলেন।

জাফর ইকবাল এখন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে থাকেন। ২৩৪ দিনের জিম্মিদশার অভিজ্ঞতা নিয়ে গতকাল বুধবার রাতে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বললেন, ‘এমভি আবদুল্লাহর নাবিক-ক্রুরা কঠিন সময় অতিক্রম করছেন।’

পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, ‘জিম্মি অবস্থায় থাকা সবার মানসিকতা একই রকম থাকে না। চাপ নেওয়ার ক্ষমতা সবার একই না। কঠিন সময়টা তাঁদের উতরে যেতে হবে।’

ক্রুদের মেরে ফেলবে—সোমালিয়ানদের এমন কোনো ইনটেনশন থাকার কথা নয়। কারণ, তাঁদের মেরে ফেললে তারা লাভবান হতে পারবে না। তাঁদের জিন্মি করেই অর্থ পেতে হবে তাদের।
- জাফর ইকবাল, জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশি নাবিক।

জলদস্যুরা হয়তো কাউকে হত্যা করবে না—এমনটাই প্রত্যাশা জাফর ইকবালের। তিনি বলেন, ‘নাবিকদের মেরে ফেলবে—সোমালিয়ানদের এমন কোনো অভিপ্রায় থাকার কথা নয়। কারণ, তাঁদের মেরে ফেললে তারা লাভবান হতে পারবে না। তাঁদের জিম্মি করেই অর্থ পেতে হবে তাদের।’

পরিস্থিতি ‘স্মার্টলি’ মোকাবিলা করতে হবে বলে মত জাফর ইকবালের। তিনি বলেন, ‘জিম্মি থাকা নাবিকদের একটু স্মার্টলি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এটা সত্য, তাঁদের চরম মানসিক চাপে রাখবে।’

জাফর ইকবালের বাড়ি ফেনীতে। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম নগরে। এখন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ‘ইন্টারটেক অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি শিপিং প্রতিষ্ঠানের অপারেশন ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন। পার্থে বসেই জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছেন।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে জাফর ইকবাল বলেন, ‘জাহাজ কিংবা জাহাজের পণ্য—সবই বিমার আওতায় রয়েছে। কিন্তু মানুষগুলোর প্রাণ হচ্ছে স্বজনদের কাছে শেষ কথা। স্বজনদের মতো জলদস্যুদের কাছেও জিন্মি থাকা নাবিকদের প্রাণ বেশ দামি।’
জাহাজ কিংবা পণ্য—সবকিছুর ক্ষতিপূরণ মিলবে। একমাত্র ক্রুদের জীবন ফেরানো যাবে না। সেটা সোমালিয়ানরাও জানে। তাই তারা এসব মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেই তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করবে। তবে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হতে পারে—এমনটাই জানালেন জাফর ইকবাল।

সশস্ত্র নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া এমভি আবদুল্লাহ কীভাবে এডেন উপসাগর পাড়ি দিচ্ছিল, সেটা এখনো মাথায় ঢুকছে না।
- জাফর ইকবাল, জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশি নাবিক।
জাফর ইকবাল

জাফর ইকবাল মনে করছেন, জলদস্যুদের সঙ্গে দর–কষাকষিতে খুব তাড়াতাড়ি সমঝোতায় পৌঁছানো কিংবা পণ্যের দাবি মেনে নেওয়া উচিত হবে না। এর ফলে জলদস্যুরা পরবর্তী সময়ে আরও বেশি অর্থ দাবি করে বসতে পারে। বিচক্ষণতার সঙ্গে বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

২০১০ সালের ৮ মে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় জাফর ইকবালের জাহাজ। মুক্তি মেলে একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর। জিম্মি থাকার সময় জাফর ইকবালের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। তিনি বললেন, শুরুর দিকে ভয়ভীতি দেখাত দস্যুরা। নানাভাবে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করত। মানসিক চাপ বেশি দিত।
জাফর ইকবাল বললেন, ‘ভয়াবহ মানসিক চাপ সামলে জিম্মি অবস্থায় থাকা ক্রুদের ফিট থাকার চেষ্টা করতে হবে। তবে জলদস্যুদের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার শঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

জাফর ইকবাল আরও বলেন, ‘সাধারণত তারা (জলদস্যুরা) কারও গায়ে হাত তুলবে না। তবে তারা তো সবাই সন্ত্রাসী ঘরানার লোক। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকে। তারা সবাই মাদকাসক্ত অবস্থায় থাকে। সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। অনেক সময় পরিস্থিতি বিগড়ে যায়। তখন দেখা যায়, কারও গায়ে হাত তুলল। কিন্তু মেরে ফেলার ইনটেনশন থাকে না। আসলে ওখানে তো কোনো আইন নেই। তবে ওই ধরনের কিছু হয় না। তবে হতেও পারে। কারণ, তাদের মানসিকতা আঁচ করা কঠিন।’

এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কবির গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি। ওই সময় জাহাজটিতে ২৫ জন নাবিক-ক্রু ও প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী ছিলেন। অপহরণের ১০০ দিন পরে, ২০১১ সালের ১৩ মার্চ ভোরে জলদস্যুরা পণবন্দীদের মুক্তি দেয়।

সম্প্রতি জিম্মি হওয়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে খাবারের মজুত বেশি দিনের নেই। যা আছে, তাতে দিন পঁচিশেক চলতে পারে। ২০১০ সালে জিম্মি হওয়া মারিডা মার্গারিটায় খাবারের সংকট দেখা দিয়েছিল বলে জানান জাফর ইকবাল।
জাফর ইকবাল বলেন, ‘সেবার যা খাবার ছিল, তা দিয়ে আমাদের প্রথম দুই মাস চলে গেছে। তারপর জলদস্যুরা কিছু ব্যবস্থা করেছিল। তবে সেটা খুবই সামান্য। ভাত, আলু, কখনো মাছ এনে দিয়েছিল। এখানেও তারা একই ব্যবস্থা করবে। কোনোভাবে বেঁচে থাকার মতো খাবার।’

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে এমভি আবদুল্লাহর নাবিক-ক্রুদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জাফর ইকবাল বললেন, ‘এটা জলদস্যুদের একটা কৌশল। প্রথম প্রথম কথা বলতে দেবে। মাসের মধ্যে দু-একবার দেবে। ক্রুদের প্রতি জলদস্যুদের কোনো আক্রোশ থাকে না। তারা চায় ক্রুরা যেন মুক্তিপণের অর্থ পাওয়া পর্যন্ত তাদের সহায়তা করেন।’
জাফর ইকবাল আরও বলেন, ‘জলদস্যুরা খুবই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করবে। ফোন করে স্বজন এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করবে। মূলত অর্থনৈতিক লেনদেন সহজ করার জন্য তারা এমনটা করে। কেননা, জলদস্যুরা জানে যে ভুক্তভোগী অর্থাৎ নাবিকেরা জিম্মিদশায় থাকলে কেউ চাপ দেবে না। এমনকি নাবিকদের  জীবনের কথা ভেবে কেউ আক্রমণও করবে না।

মারিডা মার্গারিটা জার্মানির জাহাজ হলেও পরিচালনা করত বাংলাদেশের মার্স মেরিটাইম। জিম্মি হওয়ার সময় জাফর ইকবাল অবিবাহিত ছিলেন। চট্টগ্রামের বাড়িতে ছিলেন তাঁর মা, ভাই ও বোন। তাঁদের দুশ্চিন্তার কথা ভেবে খারাপ লাগত জাফরের। তিনি বলেন, এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

জাফর ইকবাল বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা অনেক বেশি দুশ্চিন্তায় থাকত। কারণ, আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারতাম না। বেঁচে আছি কি মরে গেছি সেটাও তো জানত না। প্রথম দুই মাস মাঝেমধ্যে আমাদের ফোন করতে দিত। এরপর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। একটা সময়ের পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আতঙ্ক তৈরি করা।’

২০১০ সালের ৮ মে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিন্মি হয় জাফর ইকবালের জাহাজ। মুক্তি মেলে একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর। জিন্মি থাকার সময় জাফর ইকবালের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। তিনি বললেন, শুরুর দিকে ভয়ভীতি দেখাত দস্যুরা। নানাভাবে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করত। মানসিক চাপ বেশি দিত।

মারিডা মার্গারিটায় জাফর ছাড়াও বাংলাদেশের গিয়াস উদ্দিন ছিলেন। আরও ছিলেন ১৯ জন ভারতীয় ও ইউক্রেনের একজন ক্রু। জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সবাই মিলে জাহাজে আনন্দে মেতেছিলেন বলে জানালেন জাফর ইকবাল। মুক্ত হওয়ার পর বছরখানেক আর জাহাজে যাননি তিনি। এরপর আবারও নাবিকজীবন শুরু করেন।
জাফর ইকবাল বলেন, ‘মুক্ত হওয়ার এক বছর পর যখন আবার জাহাজে যাই, তখনো ভয় লাগত। ২০১৭ সাল পর্যন্ত জাহাজেই কাটিয়েছি। এরপর সিঙ্গাপুর চলে যাই। তখন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ছিলাম। ল্যান্ডে কাজ ছিল। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। বর্তমান একটি শিপিং প্রতিষ্ঠানে অপারেশনের কাজ দেখি। আর জাহাজে যেতে হয় না।’

এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি থাকা নাবিক-নাবিকদের মানসিকভাবে শক্ত থাকা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার পরামর্শ দিলেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, তাঁদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানকে চাপ দিতে হবে।

কবির গ্রুপের জাহাজ আগেও জিম্মি হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি এমভি জাহান মণির অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বলে মনে করছেন জাফর ইকবাল।