আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে চিন্ময়ের অনুসারীদের সংঘর্ষ।
সংঘর্ষে পুলিশের ১০ সদস্যসহ আহত হন অন্তত ৩৭ জন।
নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম সহকারী সরকারি কৌঁসুলি।
আইনজীবী হত্যার নিন্দা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। হত্যাকাণ্ডের তদন্তের নির্দেশ।
চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আদালত ভবনের মূল ফটকের সামনে রঙ্গম সিনেমা হল–সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পুলিশের ১০ সদস্যসহ আহত হন অন্তত ৩৭ জন। আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে আজ বুধবার চট্টগ্রামের আদালতে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন আইনজীবীরা।
এদিকে আইনজীবীকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করা হয়। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁর অনুসারীরা। একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখনই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আদালতের আদেশের আড়াই ঘণ্টা পর বেলা তিনটার দিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫) সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি)। লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে তিনি। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিক্ষোভকারীরা ওই আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। এ ঘটনায় তাঁরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মো. হাসান নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী বলেন, পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের প্রতিবাদে আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা প্রথমে সাইফুলের ডান পায়ে কোপ দেন। পরে ঘাড়ের পাশে কুপিয়ে হত্যা করেন। বিক্ষোভকারীদের অনেকের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র। হাসপাতালে নেওয়ার পর সাইফুল মারা যান।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী মো. তারেক আজিজ রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে কে বা কারা জড়িত, তা শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।
দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় আহত আটজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা হলেন শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক। দুজনের নাম জানা যায়নি। এ ছাড়া জেনারেল হাসপাতালে আরও ১৯ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নিবেদিতা ঘোষ জানান, আহত অবস্থায় সাত–আটজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁদের একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত
সরেজমিনে দেখা যায়, আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে কড়া পুলিশি পাহারায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। কিন্তু এর আগেই তাঁর ভক্তরা প্রিজন ভ্যানের আশপাশে অবস্থান নেন। অনেকে মাটিতে শুয়ে পড়েন। পুলিশ বারবার সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও অবস্থানকারীরা তা শোনেননি। তাঁরা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তখন পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও প্রিজন ভ্যান আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে কারাগারে নিতে পারেনি। পরে বেলা পৌনে তিনটার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা শুরু করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এরপর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। পরে চিন্ময় কৃষ্ণকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান কারাগারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে তাঁর অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। ওই সময় মোটরসাইকেলসহ কয়েকটি গাড়ি ও আইনজীবীর কক্ষের আয়না ভাঙচুর করা হয়।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় চিন্ময় কৃষ্ণর ভক্তরা প্রিজন ভ্যানের আশপাশে অবস্থান নেন। বারবার অনুরোধ করা হলেও অবস্থানকারীরা সরে যাননি। পরে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। তিনি জানান, আসামিপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ডিভিশনের আদেশ দেন। একই সঙ্গে চিকিৎসা ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, কারাবিধি অনুযায়ী সে ব্যবস্থা নিতে জেল সুপারকে নির্দেশ দেন।
প্রতিবাদ বিক্ষোভ
আইনজীবী সাইফুল হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিকেল থেকে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন আইনজীবীরা। তাঁরা আদালত ভবনের সোনালী ব্যাংকের সামনে, মূল ফটক জহুর হকার্স মার্কেট, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জেলা পরিষদের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। সড়কে আগুন জ্বালিয়ে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে স্লোগান দেন তাঁরা। জেলা পরিষদের সামনে সাঁজোয়া যানসহ বিজিবির সদস্যদের সতর্ক পাহারায় দেখা গেছে। রাত আটটার দিকে আইনজীবীদের সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অপর দিকে আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে নগরের নিউমার্কেট এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে তাঁরা চট্টগ্রাম নিউমার্কেট চত্বরে অবস্থান নেন। আধা ঘণ্টা পর তাঁরা সরে যান।
ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণেও আইনজীবীরা প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ হয়।
জামায়াতের বিবৃতি
আইনজীবী সাইফুলকে ‘প্রিয় দলীয় সহকর্মী’ হিসেবে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর আমির এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর আমির শাহজাহান চৌধুরী ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ নুরুল আমিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসকন নামধারী সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে সাইফুলকে খুন করেছে।
গত সোমবার বিকেলে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ৩১ অক্টোবর নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করে জামিনের আবেদন করা হয়েছে। আজ বুধবার এটি শুনানির জন্য রয়েছে।
অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ
এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। হত্যাকাণ্ডের দ্রুত তদন্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে কমিটি। গতকাল রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে এ দাবি করা হয়।
নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, চলমান পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরের গণহত্যাকারী পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ও দেশের বাইরের ষড়যন্ত্রকারীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর পাঁয়তারা করছে।
এদিকে এ ঘটনায় রাতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব লোহাগাড়া সাতকানিয়ার ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। পরে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের গায়েবানা জানাজা হয়।
সনাতনী জাগরণ জোটের সংবাদ সম্মেলন
নিজেদের আন্দোলনকে অহিংস উল্লেখ করে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের নেতারা বলেছেন, কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জোটের প্রতিনিধি সুমন রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘শাহবাগে আমাদের আন্দোলনের ভেতরে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে তা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।’ তিনি দাবি করেন, চট্টগ্রামে হিন্দু মনে করে ওই আইনজীবীর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। এখন চট্টগ্রামে অন্য হিন্দু আইনজীবীরাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে আজ বুধবারের মধ্যে জামিন দেওয়ার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানানো হয়। নইলে কারাগারের উদ্দেশে লংমার্চ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি সনাতনীরা স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবেন বলে জানানো হয়।
জোটের কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই: ইসকন
সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের কর্মসূচির সঙ্গে নিজেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়েছে ইসকন বাংলাদেশ। গতকাল সন্ধ্যায় ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিকে ইসকন বাংলাদেশের উদ্যোগ বলে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
তবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ইসকন বাংলাদেশ। একই সঙ্গে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতনী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছে। আরেক বিবৃতিতে ইসকন আইনজীবী সাইফুল ইসলামের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক জানিয়েছে এবং এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।
চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মানববন্ধন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতনী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দের ব্যানারে এ প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ফেনীতে বিক্ষোভ–সমাবেশ করেছে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট নামে দুটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের’ ব্যানারে কর্মসূচি পালন শুরু করে। নতুন এই জোটের মুখপাত্র করা হয় চিন্ময় কৃষ্ণকে। গত জুলাই মাসে চিন্ময়কে বহিষ্কার করে ইসকন বাংলাদেশ