কেউ বলছেন বিয়ে। কেউ বলছেন বন্ধুতা। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় এসব কিছুই না। এটা আসলে পরজীবিতা। দুটি গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে। জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠছে চট্টগ্রাম নগরের কোলাহলের ভেতর। ব্যস্ত সড়কে হেঁটে যেতে যেতে অথবা গাড়িতে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে সবার। একটি খেজুরগাছ আর তাকে জড়িয়ে আছে অশ্বত্থের ডালপালা।
চট্টগ্রাম শহরের গোলপাহাড়ের মোড় থেকে নিচের দিকে নেমে মেহেদীবাগের আমিরাবাগ হাউজিংয়ের গেটের বিপরীতে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। একটি খেজুরগাছকে অবলম্বন করে অশ্বত্থের বিস্তার ঘটছে। চট্টগ্রাম শহরে খেজুর ও অশ্বত্থ দুটিই প্রায় বিরল। এর মধ্যে এ দুটি গাছের এমন সম্মিলন পথচারীদের কৌতূহল জাগায়। চট্টগ্রামের মানুষ এটাকে ‘বেজাত্যের ওঁয়ারে বিয়া’ (ভিন্ন জাতের সঙ্গে বিয়ে) বলে অভিহিত করেছে।
গাছের অদূরে মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রফিক মিয়া নামের একজন বয়স্ক রিকশাচালক। তিনি বললেন, বিয়েটিয়ে কিছু না। পাহাড়ের জঙ্গলে এমনটি দেখা যায়। শহরের মানুষ দেখে অবাক হচ্ছে। পাখির বিষ্ঠা থেকে অশ্বত্থের চারাটি উঠে এসেছে। দালানের দেয়ালে বা ছাদে যেমনটি হয়, ঠিক তেমনটি।
রফিক মিয়া কিছুক্ষণ গাছ দুটির দিকে তাকিয়ে একটু আফসোস করলেন বিশেষ করে খেজুরগাছটির জন্য। তিনি জানালেন, শীত আসছে, হয়তো এবার শীতে এই খেজুরগাছ থেকে রস পাওয়া যাবে না। নিজের সবটুকু রস দিয়ে সে অশ্বত্থগাছটিকে লালন করছে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক এম এ গফুর বললেন, খেজুরের শিকড় মাটিতে, তার ভিত্তি মজবুত। সে পানি পায় সরাসরি মাটি থেকে। আর অশ্বত্থের জন্ম হয়েছে খেজুরের গায়ে। অন্য গাছের মাধ্যমে গাছের পানি আহরণের পদ্ধতির নাম হোস্টোরিয়া। অশ্বত্থ এই পদ্ধতির মাধ্যমে খেজুরগাছ থেকে পানি নেয়। খেজুরের ডালপালা নেই। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera। আর অশ্বত্থের বৈজ্ঞানিক নাম Ficus religiosa। অনুকূল পরিবেশ পেলে এই গাছ মহিরুহে পরিণত হয়। চারদিক ছায়া ফেলে। পাখিরা এসে ভিড় করে এর ডালপালায়। তবে একদিন দেখা যাবে খেজুরগাছটি একসময় অশ্বত্থের আড়ালে হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ছড়ায় খেজুরের এই পরিণতির কথা এভাবেই বলা যায়— আঁ–র ফেডর বাছা/ তারলাইবুলি কঠিন অইয়ি / আঁ–র দুনিয়াত বাঁচা। (আমার পেটের বাছাটির জন্য দুনিয়াতে আমার বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে গেল।) খেজুরগাছের এই আহাজারিতে যেন পৃথিবীর দুঃখিনী মায়েদের আকুতি প্রতিধ্বনিত হলো।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অসম গোত্রের দুটি বৃক্ষের এই সম্মিলন সত্যিই সুন্দর। এ রকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য যত বেশি থাকবে, তত আমাদের নগরের সৌন্দর্য বাড়বে। পরিবেশও সুন্দর হবে। এই শহরে দিন দিন সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ ইচ্ছেমতো পাহাড়, জলাশয়, মাঠ—এসব ধ্বংস করছে। প্রাচীন এই শহরের শতায়ু গাছের সংখ্যা কমছে দিন দিন। তাদের রক্ষার কিংবা নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেই। ধূলিধূসর এই শহরে মানুষের আচরণের বিরুদ্ধে খেজুর আর অশ্বত্থ যেন বোবা ভাষায় প্রতিবাদ করছে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল।
খেজুর আর অশ্বত্থের জুটি, তাদের যৌথ জীবন শত শত বছর পার করে দিক। দুই দশক, তিন দশক পর সেই সময়ের ব্যস্ত মেহেদীবাগে দ্রুতগামী যানবাহন থেকে একবার সবুজের বিস্তারের দিকে তাকিয়ে পথিকের মনে যেন শান্তি নেমে আসে।