তিনটি বিশেষ পাখির সন্ধানে পাখিপ্রেমী আমরা কজন পদ্মা নদীর দুটি চরে অভিযানে বেরিয়েছি। শীত শীত ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটে নামলাম সকাল পৌনে আটটায়। জাকির মাঝির ইঞ্জিন নৌকা ঘাটেই ছিল। নৌকা ছাড়তেই পদ্মা সেতু ঘিরে ফটোসেশন শুরু হয়ে গেল। পাখির ছবি তোলার আগে কিছুটা গা গরম করা আরকি।
৫০ মিনিট প্রমত্ত পদ্মার বুকে চলার পর নৌকা লৌহজং উপজেলার বেড়ামনগাঁও চরে ভিড়ল। চরের মাটিতে পা রেখেই প্রথম পাখিটির দেখা পেয়ে গেলাম। এরপর পাক্কা দুই ঘণ্টা চরের বিভিন্ন অংশে ঘুরলাম। কিন্তু সাধারণ পাখি ছাড়া বিশেষ কোনো পাখির সন্ধান মিলল না।
বেলা ১১টায় দ্বিতীয় চরের উদ্দেশ্যে নৌকা ছাড়ল। আবারও পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে গেলাম। ঠিক ১২টায় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালিয়া-চন্দ্রা চরে নামলাম বাকি দুটি বিশেষ পাখি খোঁজার জন্য। চরের পাড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে কাশবন পেরিয়ে কিছুটা ভেতরে গেলাম। পরপর বেশ কটি ধানখেত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সব ধানখেতই সূক্ষ্ম সুতার কারেন্ট জালে ঘেরা। পাখি-প্রাণীর হাত থেকে মূল্যবান ফসল রক্ষার প্রয়াস আরকি! ধানখেতের আশপাশে বাকি পাখি দুটিকে খুঁজতে লাগলাম।
কাশগাছে বাবুই পাখির ছবি তুলছি, এমন সময় জালে ঘেরা ধানখেতের পাশ দিয়ে দুজন চাষিকে যেতে দেখলাম। হাসিমুখে ওঁদের বললাম, ‘খেতে কারেন্ট জাল কেন? আপনারা একা খেলেই হবে, পাখিদের কী খেতে হবে না? আপনাদের খাদ্যের জোগান ঠিক রাখার জন্যই কিন্তু ওদের দরকার। ওরা আপনাদের শত্রু নয়, পরম বন্ধু। কারণ, বেশির ভাগ পাখি ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ফসল রক্ষা করে। যদিও মাঝেমধ্যে কিছু শস্যদানাও খায়; তবে সে তুলনায় উপকার করে অনেক বেশি। কাজেই এভাবে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে ফসল ঘিরে রাখা অনুচিত।’
কথাগুলো শুনে ওঁরা প্রথমে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেও পরে স্বীকার করলেন যে পাখিদেরও বাঁচার অধিকার আছে। ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ কথার অর্থও তাঁদের বোঝালাম। এরপর তাঁরা বিদায় নিয়ে পাড়ের দিকে চলে গেলেন। আমরাও পাখির খোঁজে আশপাশে হাঁটতে লাগলাম।
খানিক পর কারেন্ট জালে ঘেরা ধানখেতের একটি পাকা শিষে ঠোঁট চালাল ধানটুনি নামের ক্ষুদ্র এক পাখি। কিন্তু মাত্র ৩০ সেকেন্ড। পরের শিষটিতে ঠোঁট চালাতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে জালের মিহি সুতার ফাঁদে আটকে গেল। মুক্তির প্রচেষ্টায় যতই ডানা জাপটাচ্ছে, ততই জড়িয়ে যাচ্ছে জালের ফাঁদে। সবাই আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেকে ছবি তুলছে। পাখিটির কাছে আমরা পাঁচ-ছজন ছিলাম। আমরা পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া–চাওয়ি করে মুহূর্তেই করণীয় ঠিক করে ফেললাম।
চেষ্টা করলাম জাল না কেটে আলতোভাবে পাখিটিকে মুক্ত করতে। কিন্তু পাখিটি জালে এতটাই জড়িয়ে গেছে যে সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এরপর আমি জালের প্রতিটি সুতা আলগা করে ধরতে লাগলাম ও পক্ষী আলোকচিত্রী ফরিদি নুমান ছুরি দিয়ে তা কাঁটতে লাগল। অন্যরাও নানাভাবে সাহায্য করল।
আর এভাবে একসময় ওকে মুক্ত করে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু হতভাগা পাখিটি উড়তে গিয়ে আবারও জালের ফাঁদে জড়িয়ে গেল। কাজেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হলো। এবার পাখিটিকে কারেন্ট জালে ঘেরা ধানখেত থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। যাক অন্তত একটি পাখিকে তো রক্ষা করা গেল!
তবে এ রকম ঘটনা এবারই যে প্রথম ঘটল, তা নয়। আগেও বিভিন্নœস্থানে জালে আটকে পড়া পাখি দেখেছি। ওরা ধান বা শস্য খায় সত্য, কিন্তু ফসলের কি খুব বেশি ক্ষতি করে? না, বরং ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে প্রকারান্তরে কৃষকের উপকারই করে। অথচ প্রায়ই আমরা শস্য বা সবজিখেত ও ফলের বাগানে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল পেতে রাখি। মারা পড়ে প্রচুর পাখি-প্রাণী।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই তো দুজন চাষির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে পাখিদের খাদ্য ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও জালে আটকাল পাখিটি। কাজেই সম্মানিত চাষি ভাইদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা ফসল রক্ষার নামে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করবেন না।
তারপরও যদি করেন, তাহলে মোটা সুতার জাল লাগান। তাতে অন্তত অবোলা পাখিগুলো বেঘোরে প্রাণ হারাবে না। পাখিরা শুধুই প্রকৃতির অলংকার নয়, অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। ওরা না থাকলে প্রকৃতিও ধ্বংস হবে। তাতে ক্ষতি হবে মানুষেরই। পাখিদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ রইল। এ ব্যাপারে সুশীল সমাজ ও সরকারের হস্তক্ষেপও কামনা করছি।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ